আব্বা আর আমি, স্মৃতি অমলিন
মৃত্যুর আগে সনদ মোতাবেক তার বয়স ছিল চৌষট্টি। অরিজিনাল আরও বেশি হতে পারে। চার ভাই, ছয় বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বলছি আমার আব্বার কথা। তাঁকে আমি আব্বা বলেই ডাকি। আব্বার বিয়ের আগেই দাদা চলে যান না ফেরার দেশে। বড় পরিবার, বড় দায়িত্ব। সেসব বিরাট হিস্ট্রি। সবটা ভালো জানিও না। শুধু অনুভব করার চেষ্টা করি, কতটা ভর তাঁর কাঁধের উপরে নিত্য করত বসবাস! ছোট করে বলতে চাইলে বলব, ‘বড় ছেলে’। যা আমি দেখিনি তা জানা থাকলেও এখানে বলব না।
আমার আব্বার ছয় ছেলে, এক মেয়ে। আমি সবার ছোট। আদরটা বোধহয় সবার থেকে একটু বেশিই পেয়েছি। আমার দেড় যুগের জীবনে আব্বার সাথে ঘুমিয়েছি এক যুগের বেশি বৈ কম নয়। প্রাইমারি থেকে দশম অবধি আব্বা আমার ঘুমের সঙ্গী। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন ফাজিল মাদ্রাসার আরবী শিক্ষক। তাই, সবাই হুজুর বলেই ডাকত। ছোট সময় ঘুমানোর আগে আব্বার মুখে কিচ্ছা শুনতাম। নবী-রাসূলের কিচ্ছা। ফেরাউন, নমরুদের ইতিহাস। মশারি টানানো বিছানায় শুয়ে গভীর মনোযোগে শুনতাম। বিনিময়ে আবাদি জমির মতো আব্বার পিঠ চুলকে দিতাম, মাথায় হাত বুলাতাম। মাঝে মাঝে আমিও পেতাম ওসব। ঘুমানোর আগে কেউ পিঠ চুলকে দিলে দারুণ মজা লাগে। আবার কখনও নিজের জীবন থেকে ওঠে আসা কিচ্ছা শুনাতেন। কোথায়, কোনকালে, কাকে সানি বিচারের মাধ্যমে ন্যায্য বিচার পাইয়ে দিয়েছেন সেসব। বেশ ভালো লাগত। গ্রীষ্মের রাতে লোডশেডিং-এর সময় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে আমাকে ঘুম পাড়াতেন। গরম আমার অসহ্য ছিল। সে রাতগুলো এখনও উজ্জ্বল। আব্বা এখন আর নেই, বছর দেখি পেরিয়ে গেল! এখন কেউই আমার সঙ্গে ঘুমায় না, কিচ্ছা শুনায় না, পিঠ চুলকে আদর করে না, লোডশেডিং-এর রাতে হাত পাখায় বাতাস করে না।
বিজ্ঞাপন
আগেই বলেছি, আব্বা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। প্রাইমারি পাশ করার আগ অবধি বহুবার গিয়েছি আব্বার সাথে তাঁর মাদ্রাসায়। আমি একটা ভাব নিয়ে থাকতাম। হুজুরের ছেলে বলে কথা। ছাত্র, শিক্ষক সবাই আদর করত। মাদ্রাসায় গেলেই আব্বার সঙ্গে তাঁর ক্লাসে যেতাম। সব ক্লাসেই ঘুরেছি। আমাকে বসানোর জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে হিরিক পরে যেত। কার পাশে বসাবে এ নিয়ে তর্ক। রহিমা বলত তার পাশে আর কুলসুমা তো ছাড়বেই না। আবার ওইদিকে ছেলেরাও টানাটানি করে। ব্যাপারগুলো খুব ভালো লাগত আমার কাছে। ছাত্রীদের সাথেই বসেছি বেশি। ছাত্ররা ভাগে পেতো কম। যাই হোক, তখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপহার পেতাম। খাবার! চিপস, চকলেট, জুস কত কী! অনেক হুজুরও দিতেন। আব্বা এখন আর নেই, বছর দেখি পেরিয়ে গেল! চাইলেও আর তাঁর হাত ধরে যাওয়া যাবে না মাদ্রাসার মুখরিত ক্লাস রুমে।
আগে গ্রামে কোনো না কোনো বাড়িতে মাসে অন্তত চার-পাঁচটা মিলাদ লেগেই থাকত। কারো ছেলে বিদেশ যাবে, কারো আবার মেয়ে হলো, কোনো ছেলের খতনা হলো নানান কিসিমের দাওয়াত। সব দাওয়াতই আব্বা পেতেন। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন অধিকাংশ লোক আব্বার সাথে আমাকেও দাওয়াত করে যেত। হয়তো ভাবত, ছোট ছেলে কী আর খাবে! আবার এরকমও ভাবতে পারে, হুজুরের ছেলেসহ দাওয়াত দিলে হয়তো হুজুর খুশি হয়ে মোনাজাতটা যুৎসই করে দেবেন। যেসব গায়েবি ভাবনার কথা আমি জানি না। দাওয়াত পেতাম, যেতাম আর খেতাম, ব্যাস। কেউ কেউ তো রোস্ট দুই পিস দিয়ে আরেক পিস জোরাজুরি করত। সে কী খাতির যত্ন, বাপরে! আব্বার সাথে অনেক ওয়াজেও গিয়েছি। আমার স্থান স্টেজে হতো। বড় বড় হুজুদের পাশে। যতই বড় হতে থাকলাম আমার দাওয়াতের সংখ্যাটা ততই কমতে থাকলো। কমতে কমতে এখন শূন্যর সমান কারণ আব্বা এখন আর নেই!
আব্বা শিক্ষিত লোক। মাওলানা মানুষ। সম্মানিত ব্যক্তি। গ্রামের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কত শালিশী করতে দেখেছি তাঁকে। গ্যাঞ্জামের বিষয়বস্তুর কমতি নেই। ওর মুরগির বাচ্চায় আমার ঘরে হাগলো কেন? আচলের সারি মাজায় বেঁধে লেগে গেলো দুই গেরস্তের ঘরনি। ঘটনাটা পুরুষে প্রবাহিত হতে না হতেই শুরু হয় হাতাহাতি। পুরুষ মানুষ মেয়েদের চেয়েও বোকা কারণ তাদের বেশিরভাগেই মেয়েদের কথায় নাচে। উত্তেজিত হয়ে কিল, ঘুষি মেরেও খুশি না হয়ে আবার শালিশ বসায়। এরপর বলে, ‘এর একটা হ্যাস্তন্যাস্ত চাই, মাওলানা সাব।’ গ্রামীণ গ্যাঞ্জাম এরকমই। ছোটখাটো বিষয়। কিছু কিছু আছে বড় ঝামেলার। সবগুলোরই কোন না কোন সমাধান হতো। কখনও জরিমানা আবার কখনও ধমক টমক দিয়ে, মাফ চাইয়ে ঘটনা খালাস। আমার আব্বা আবার ধমক দিতে ওস্তাদ। ভরাট গলা, দুষ্টুমি করে ধমক দিলেও অনেকে থতমত খেয়ে উঠতো। জীবনে বেশ কয়েকবার তাঁর ধমক আমিও খেয়েছি। তবে মাইর কখনও খাইনি। মাইর যতটুকু খেয়েছি মায়ের হাতেই।
আমার কোন বায়না আব্বা অপূর্ণ রেখেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। আকাশ ছোঁয়া আহাম্মকী বায়না আমি ধরতাম না। যা চাইতাম, সামর্থ্যের মধ্যেই। আব্বা কখনও নিষেধ করেননি। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট ব্যাট আর বল, ঈদের সময় দিয়াশলাই কতবার যে কিনেছি তার ঠিক হিসেব নেই। ছোটবেলায় আমি একটু নাঠা প্রকৃতির ছিলাম, এখনও হয়তো তা-ই। একদিন বিকেলে খাসেরহাট থেকে আমার জন্য আব্বা স্যান্ডেল কিনে আনলেন। আমার পছন্দ হয়নি। শুরু হয়ে গেলো হুলুস্থুল, কান্নাকাটি। কে ঠেকায় আমাকে! স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারলাম পুকুরে। তারপরেও কান্না থামেনি। কান্না থামানোর জন্য আব্বা কোলে নিয়ে দোকানের দিকে যেতেন। তখন তাঁর দাঁড়ি টেনে দূর্বল করে দিতাম। দোকানে কিছু খাওয়ার পরে অবশ্য শান্ত হয়ে যেতাম। ওইদিকে কে যেন পুকুর থেকে স্যান্ডেল তুলে এনেছে তা আমি জানতাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেই স্যান্ডেল! মাথা অটোমেটিক গরম হয়ে গেলো। এবার আর হাউমাউ করলাম না। একটা ব্লেড খুঁজলাম। ব্লেড দিয়ে স্যান্ডেলের বুটু এরকমভাবে কাটলাম যাতে কয়েকদিন পরলেই ছিঁড়ে যায়। ছোটবেলায় ব্লেড দিয়ে কেটে অনেক স্যান্ডেলের জীবনী থামিয়ে দিয়েছি। পছন্দ না হলে কাটতাম আবার বেশিদিন পরার পরেও যদি না ছিঁড়ত তাহলেও কাটতাম। এক জিনিস আর ক’দিন ভালো লাগে!
এরকম বলার মতো কত কী স্মৃতি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার হিসেব নেই। অথচ, যাকে নিয়ে এত স্মৃতি তিনি থাকলেন না শুধু। এত এত স্মৃতি রেখে- মানুষ কি কোনদিন পারে, পৃথিবী থেকে মুছে যেতে?
ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়