ছবি: প্রতীকী

আমার বাবা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। দীর্ঘ ২৮ বছরে বাবার সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়েছে। এই দুই যুগেরও বেশি সময়ে দেশে এসেছেন কেবলই আমাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে। কোনো ঈদ কিংবা উৎসব পার্বণে নয়। বরং বছরের অন্যদিনগুলোতে আসতেন তিনি। সে হিসেবে বাবার সঙ্গে কোনো ঈদ করেছি বলে মনে পড়ে না। তবে বাবার কাছ থেকে শুনেছি, আমার বয়স যখন এক বছর ছিলো, তখন নাকি বাবার সঙ্গে ঈদ করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। 

সরকারি কলোনিতে আমার বেড়ে ওঠা। বিকেলে কলোনির লম্বা বারান্দার বিল্ডিংয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। হঠাৎ দেখতাম এক বন্ধু বল কুড়াতে গিয়ে উধাও। কেউ আবার ‘বাবা এসেছে, বাবা এসেছে’ বলে চিৎকার করতে করতে আনন্দে আত্নহারা। আর যে বন্ধু বল কুড়াতে গিয়েছিল সেও দেখি তার বাবার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট কিংবা ফলের তোড়া নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে যায়। আমার বন্ধুদের প্রায় সবার বাবাই সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। তারা বিকেল ৫টায়ই অফিস শেষে ঘরে ফিরতেন। কিন্তু আমার বাবা প্রতিদিন বিকালে ফিরতেন না। তিনি আসতেন অসুস্থ হয়ে কিংবা বছর চারেক বাদে। 

বাবার আদর-শাসন ছাড়াই বেড়ে উঠছিলাম। তখন ঈদ বা কোনো দিবসে বাবা কেন্দ্রিক কোনো বিজ্ঞাপণ দেখলে খুবই আবেগাক্রান্ত হতাম। আবেগতাড়িত হয়ে স্মৃতির সাগরে ডুব দিতাম। বাবার সঙ্গে ভালো কোনো মুহূর্ত কিংবা নিছক কোনো স্মৃতি আছে কি না খুঁজতাম। 

তখন ক্ষুব্ধ হৃদয়ে আঁচড় কেটে ভাবতাম, আমার বাবা এমন কেনো? বাবার কি কখনো ইচ্ছে হয়নি একসাথে ঈদ করতে? আমাদের ঈদের বাজার করে দিতে? একসাথে ঈদের নামাজে, ঘুরতে কিংবা আমাদের ছোট ছোট শখগুলো পূরণ করে দিতে? কখনোই কি ইচ্ছে হয়নি তার সন্তানদের একটু বুকে জড়িয়ে ধরতে? এমন আরও সহস্র প্রশ্নের উত্তর খুঁজতাম আমি।

জীবনের নিয়মে স্কুল, কলেজ, পেরিয়ে প্রবেশ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরমধ্যে বাবার সঙ্গে আমার দূরত্ব হয়েছে এভারেস্ট সমান। আর সম্পর্কটা বাবা-ছেলে হলেও, আদতে ছিল টাকার। মানে, তখন বাবার সঙ্গে কথা হতো কোনো নাটকের একটা মুখাস্ত স্ক্রিপ্টের মতো। তা ছিল এমন : ‘হ্যালো! আব্বু, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? কি করেন? ওহ! হ্যাঁ আমার সেমিস্টার ফি লাগবে। ওকে আল্লাহ হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম।’

শুনতে অবাক মনে লাগলেও আমাদের এতটুকুই কথা হতো। কখন যে এত বড় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। আস্তে আস্তে সেই আবেগুলো ধুয়ে গেছে, ইচ্ছেগুলো মরে গেছে; বাবার সাথে তখন যে দূরত্ব হয়েছে তার পরিমাপ জানা নেই।

তবে এতসব প্রশ্নের উত্তর আমি এখন একটু একটু অনুধাবন করছি। আট মাস হতে চলল, জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছি। আর বুঝতে শুরু করছি যে, দেশের তুলনায় এই বিঁভূইয়ের বাস্তবতা কতশত গুণ কঠিন। 

অতি সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে পড়েছিলাম: ‘ভোরে শুধু তিন শ্রেণীর মানুষই জাগেন। মা, শ্রমিক এবং যার মজবুরি বা বাধ্যকতা আছে।’ এরমধ্যে হয়ত আমার বাবার বাধ্যবাধকতাই দায়বদ্ধতাই ছিল। এজন্য হয়ত তিনি চাইলেও আমাদের মাঝে আসতে পারেননি। বাধ্যবাধকতা ছিল তার একান্নবর্তী পরিবারের প্রতি। যেখানে তার উপর্জনে ঢাকা শহরে নয় সদস্যের একটি সংসার চলতো। এরমধ্যে চারজন আমরা লেখাপড়া করতাম। হয়ত এজন্য তার ইচ্ছাকে মাটিচাপা দিয়ে নিজে একা কষ্ট করে বাড়ির বাকি সবাই যেন দুধেভাতে থাকে তিনি তা চেয়েছেন।

অভিমান যেহেতু স্থিতিশীল নয়, তাই পরিবর্তন ঘটেছে। বাবার সঙ্গে এখন আমার নিয়মিত কথা হয় ঘণ্টা ধরে। সর্বনিম্ন ১ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত। এখানের অনেকেই আমায় বলে, ‘বাবার সাথে এত কথা কিসের? এত সময় পাও কিভাবে? মানুষ তো এত কথা তো তার প্রেমিকার সাথেও বলে না।’

হয়ত তারা ঠিকই বলে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমি সত্যিই বাবাকে অনেক ভালোবাসি, যার পরিমাপক কী হবে জানা নেই। আর এই কথাও সত্য যে; বাবার প্রতি অভিমান এখনো আছে, কারণ যার প্রতি ভালোবাসা তার প্রতিই আবার অভিমানও একটু বেশি হয়।

তবে বাবার সঙ্গে এক সময়ের হিমালয় পরিমাণ দূরত্ব আমাকে বিষিয়ে তুলেছে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আমার বাবার মতো হতে চাই না। বাবার মত এত লম্বা লম্বা বিরতিতে বাড়িতে যেতে চাই না। বাবার মতো পরিবারের সাথে ঈদ না করে থাকতে চাই না, ইনশাআল্লাহ। সবশেষে বলবো, শুধু বাবা দিবসে নয় সব সময়, দোয়া করি সবার বাবা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক, পরিবারের সঙ্গে থাকুক।

লুইজেন্টাল, ব্রেমেন, ২৮৩৫৯, জার্মানি।