আমার আব্বা, আমার স্বপ্ন পূরণের কারিগর
তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টিমের অন্ধ ভক্ত। বিশেষ করে স্টিফেন ফ্লেমিং, শেন বন্ড, স্কট স্টাইরিস, জেসে রাইডার, জেকব ওরাম, ড্যানিয়েল ভেট্টোরির খেলা আমাকে খুব টানতো। গ্রামে থাকি খেলা দেখার তেমন সুযোগ ছিল না। হাতেগোনা দুই এক বাড়িতে টিভি ছিল। তবে সেগুলো কালার নয় সাদাকাল। কালার টিভি কি জিনিস সেটা তখন আমি বুঝতাম না।
সাদাকালো টিভিগুলো চলতো রিচার্জেবল ব্যাটারিতে। বাঁশের মাথায় এন্টেনা বেঁধে দিয়ে দেখতে হতো সেই টিভি। আমাদের পরিবার ছিলো নিন্মমধ্যবিত্ত। তাই আব্বার টিভি কেনার সামর্থ্য ছিল না।
বিজ্ঞাপন
নিউজিল্যান্ডের কোনও সিরিজ থাকলে আমি অন্যদের বাড়িতে যেতাম খেলা দেখতে। অন্যদের বাড়িতে গেলে তারা ঠিকি খেলা দেখতে দিতো আমাকে, তবে এর বিনিময়ে তারা কাজ করিয়ে নিতো আমাকে দিয়ে। খেলা দেখার নেশায় আমি সব করতাম খুশি মনে।
সেবার সম্ভবত নিউজিল্যান্ড টিম ভারতে এসেছিল তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজ খেলতে। প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ড জিতলো। দ্বিতীয় ম্যাচ দুদিন পরেই। খেলা শুরু হবে দুপুর ২টায়। আমি খেলা দেখার জন্য সেদিন স্কুল ফাঁকি দিলাম। বাড়ির সবাই একটু বকাবকি করলো। তবে আমি তেমন গায়ে মাখলাম না।
দুপুরে না খেয়ে এক বাড়িতে খেলা দেখতে হাজির। তারা বুঝতে পেলে আমাকে বিল থেকে ইট নিয়ে আসার বিনিময়ে খেলা দেখতে দেওয়ার শর্ত দিলো।
প্রিয় দলের খেলা দেখার লোভে প্রচণ্ড রোদেও আমি রাজি হলাম। রোদে শরীর ঘেমে মাথা ব্যথা শুরু হলো। কিন্তু তারা আমাকে খেলা দেখতে দিলো না। এদিকে প্রচণ্ড রোদে কাজ করায় আমার জ্বর এলো। টানা তিন দিন গায়ে জ্বর। আব্বা-মা চিন্তিত।
তিনদিনের মাথায় তৃতীয় ম্যাচ ছিলো। সেদিনের খেলাটা ডে-নাইট ছিলো। আমার তখনও জ্বর। একবার আব্বার খোঁজ নিলাম। মা জানাল কোথায় যেন গেছে। তারপর আবার ঘুমিয়ে গেলাম।
বিকেলে আব্বার ডাকে ঘুম ভাঙলো। আব্বা বলল, খেলা দেখবি না? নিউজিল্যান্ড তো ব্যাটিং করছে। আমি বললাম কোথায় দেখব? বাবা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, তোর সামনেই তো টিভি। আমি বিস্মিত চোখে দেখলাম, সত্যিই আমাদের ঘরে টিভি চলছে। নতুন টিভি, ন্যাশনাল, সাদাকালো ২১ ইঞ্চি টিভি। আমি খুশিতে লাফালাফি শুরু করলাম। আমার আর জ্বর নেই শরীরে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, সাদাকালো টিভির আলো পড়ে আব্বার চোখগুলো ছলছল করছে। আমার আনন্দ আব্বার চোখে অশ্রুকণা হয়ে জমেছে। সেদিন খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলাম সন্তানের খুশিগুলো বাবাদের চোখের পানিতেও মিশে থাকে। সেদিন নিউজিল্যান্ড ম্যাচ জেতে এবং ২-১ সিরিজও জেতে। কারণ দ্বিতীয় ম্যাচটা তারা হেরেছিল।
এরপর বাবার কিনে দেওয়া টিভিতে অনেক খেলা, নাটক, মুভি দেখেছি। প্রতি শুক্রবার আলিফ লায়লা দেখতাম। পরে জেনেছিলাম আব্বা টাকা ধার করেই টিভি কিনেছিল। তখন জেনেও কিছু মনে হয়নি। এখন মনে পড়লেই খারাপ লাগে। তবে এটুকু বুঝতে পারি আমার আব্বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবাদের একজন।
সহ-সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার।