ছবি: প্রতীকী

বাবা একটা সম্পর্কের নাম, একটা প্রগাঢ় অনুভূতি, তুমুল ভরসা আর বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল। বাবা তপ্ত রোদ গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা এক অচীন বৃক্ষ। সেই বৃক্ষ আমৃত্যু ছায়া দিয়ে যায়। কিন্তু অনেকের জীবনেই সেই ছায়া দীর্ঘজীবন ব্যাপী থাকে না। আমার বাবা চলে গেছে প্রায় ৪ বছর হলো। তবে বাবা না থাকলেও বাবার অনেক জীবনমুখী শিক্ষা রয়ে গেছে জীবনজুড়ে।

আমি যখন শহরে নতুন আসি, রাস্তা পার হতে ভয় পেতাম, কোনো একটা নতুন জায়গা সহজে চিনতে পারতাম না। বাবা বলতো, যদি রাস্তা পার হওয়র প্রয়োজন হয়, আর সেখানে ফুটওভার ব্রিজ থাকে, তাহলে অবশ্যই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবে। কিন্তু ব্রিজ না থাকে, তাহলে সিগনালের জন্য অপেক্ষা করবে। সিগনাল দিলে রাস্তা পার হবে নির্বিঘ্নে। আর এমন কোনো জায়গায় যদি রাস্তা পার হতে হয়, যেখানে ব্রিজও নেই, সিগনালও নেই, সেখানে ডানে বায়ে ভালোভাবে দেখে তারপর পার হবে, ওই একই সময়ে সেখান দিয়ে যদি আরো মানুষ পারপার হয় তাহলে তাদেরকে অনুসরণ করে একসাথে রাস্তা পার হবে। বড় হয়ে যাওয়ার পরও বাবা সবকিছু এভাবে সুন্দর করে শেখাতো। এখন শহরে থাকি প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। এখন আর রাস্তা পার হতে অতটা ভয় লাগে না। আবার নতুন জায়গা চেনার ক্ষেত্রে বাবা বলতো, যখনই কোথাও যাবে সেখানকার স্থায়ী দোকানপাটগুলোর সাইনবোর্ড মনে রাখার চেষ্টা করবে। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে কোন গলি থেকে কোন গলিতে যেতে হবে বা কীভাবে যেতে হবে। বাবার শেখানো এসব টিপস ভীষণ সহজ করে দিয়েছে আমার চলার পথ।

বাবা আরেকটা দারুণ কথা বলতো, ‘পৃথিবীর যে দেশেই ঘুরতে যাও না কেন, সেখানকার জাদুঘর অবশ্যই দেখবে। জাদুঘর দেখা মানে পুরো দেশ সম্পর্কে সামগ্রিক একটা সুন্দর ধারণা পাওয়া।’ বাবার এ কথাটা আমি মেনে চলি। আমি কোনো জেলায় বা শহরে ঘুরতে গেলে, সেখানে কোনো জাদুঘর থাকলে অবশ্যই দেখার চেষ্টা করি। জাদুঘর দর্শনের মাধ্যমে অনেককিছু সম্পর্কে জানা যায়, এমন অনেককিছু দেখা যায় যা হয়তো জাদুঘরের বাইরে দেশের অন্য কোথাও দেখা সম্ভব নয়।

বাবা বলতো, অন্যের ওপর যতটা সম্ভব কম নির্ভরশীল হবে। একটা কাজের জন্য যদি অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, কিন্তু তুমি একটু কষ্ট করলেই সেই কাজটা শিখে নিতে পারবে, নিজে করতে পারবে, তাহলে তা অবশ্যই শিখে নিবে। আবার ধরো, তোমার কোনো একটা জিনিস প্রয়োজন, হতে পারে তা সারাজীবনে মাত্র একদিন বা একবারের জন্যেই প্রয়োজন, তবুও চেষ্টা করবে সেই জিনিসটা অন্যের কাছে না চেয়ে নিজে কিনে নিতে। আর যদি তা নিজের সাধ্যের বাইরে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। বাবার সংগ্রহে আমি এমন অনেক জিনিসই দেখেছি, যা গোটা জীবনে তেমন একটা প্রয়োজন হয়নি ব্যবহারের, তবু বাবা তা কিনে নিজের সংগ্রহে রেখেছে, হয়তো কোনো একদিন প্রয়োজন হয়েছিল তাই।

স্কুলজীবনে অনেক অভিভাবককে দেখতাম, সন্তানকে শিক্ষা সফরে যেতে দেয় না। কিন্তু বাবা সবসময় বলতেন, অবশ্যই শিক্ষা সফরে যাবে, অনেককিছু দেখতে পারবে, শিখতে পারবে। এটা ঠিক যে, বাবা কখনো বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে দিত না, তবে শিক্ষকদের সঙ্গে সবসময় আগ্রহের সাথে যেতে দিত। সুন্দরভাবে আমাকে শিক্ষা সফরের প্রয়োজনীয়তা শোনাতো। ঘুরে আসার পর আমি কী কী দেখলাম, কী শিখলাম, গল্পে গল্পে এসব জানতে চাইতো।

বাবা আরেকটা কথা বলতো, হাত খরচের টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে জানাবে। টাকা না থাকলে নিজেকে অসহায় লাগে। আমি বেঁচে থাকতে কখনো নিজেকে অসহায় ভাববে না। কারো কাছে কখনো টাকা ধার চাইবে না, ঋণ করলে নিজের মনের কাছে বোধের কাছে ছোট হয়ে থাকতে হয়, তোমার যেটুকু আছে সেটুকু দিয়েই জীবন যাপন করার চেষ্টা করবে।

বাবার কাছে চিরকাল যত বিষয়ে প্রশ্ন করেছি, বাবা কখনো বলেনি আমি বলতে পারবো না, আমি জানি না। বাবা অনেককিছু জানতেন। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরই সঙ্গেসঙ্গে পেয়ে যেতাম। যেসব ব্যপারে জানতেন না, তা সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে জ্ঞান অর্জন করে আমাদেরকে জানাতেন। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের দশকে সম্পর্ক ও গ্রামীণ জীবনযাপন, রাজনীতি, অর্থনীতি, এমন নানাবিধ ব্যপারে বাবার সাথে বিস্তর আলাপ আলোচনা হতো। বাবার মতো ধৈর্যশীল বক্তা আর শ্রোতা আমার নিকটজনের মধ্যে আর কাউকে দেখিনি।

বাবা কিংবা মা কে নিয়ে লিখতে গেলে কখনো লেখা শেষ হবে না। তবু অসমাপ্ত রেখেই ইতি টানতে হয়। বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবাদের শ্রদ্ধা জানাই। যে যেখানে আছে, সবাই খুব ভালো থাকুক।