ছবি: প্রতীকী

আব্বার কবরের সামনের দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াতের সময় মনে হচ্ছিল মুহুর্তের জন্য হিমশীতল হয়ে গেছে আমার পুরো দুনিয়া, প্রখর রোদ পরিণত হয়েছে শীতল ছায়ায়। মনে হলো এক ঝলকের জন্য যেন আব্বাকে দেখেছি, শোঁ শোঁ বাতাসের আওয়াজের সঙ্গে শুনছি আমার নাম ধরে ডাকা আব্বার সেই ভরাট কণ্ঠ! ঠিক তেমনভাবে, যেমনভাবে আব্বা বাড়ি ঢুকেই নাম ধরে ডাক দিতেন। দুই হাতে ব্যাগ ভরা সদাই নিয়ে আব্বা বসতেন ঠিক দাদাজানের পায়ের কাছে। আব্বা বাসায় ঢুকতেই আমরা সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতাম। 

একদিন সকালে আব্বার স্যান্ডেল পরতে গিয়ে ছিড়ে ফেলি। ভয়ে সেই ছেড়া স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে দেই যেন কেউ না দেখে। আব্বা ঘুম থেকে ওঠার আগেই চলে যাই স্কুলে। কিন্তু বিধিবাম- আব্বা স্কুলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। কলিজা শুকিয়ে কাঠ, আজকে নির্ঘাত ঝাড়ি খাবো তাও বন্ধুদের সামনে। এই ভাবতে ভাবতে যখন ভীরু পায়ে আব্বার দিকে যাই, আব্বা পকেট থেকে ২০ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বলে- ‘খেয়ে নিস কিছু, তোকে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পাইনি, খারাপ লাগছিল’ বলে যখন চলে যাচ্ছিল- তাকিয়ে দেখলাম আব্বার পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই, প্রায় ১০০ কেজি ওজনের মানুষটা খালি পায়ে তার একমাত্র সন্তানকে দেখতে এসেছেন প্রায় ৩০ মিনিট দূরত্বের খোয়া- বালি- কাঁদা মাখা পথ হেঁটে!

ঈদ ঘনিয়ে এলেই দেখতাম আব্বার চোখেমুখে বিশাল চিন্তার পাহাড়। ঈদ আসার আগে নিজের পুরনো পাঞ্জাবি ধোলাই- ইস্ত্রি করে তুলে রাখতেন, কেনার মধ্যে কেবল হয়তো একটা লুঙ্গি কিংবা দুই ফিতার একজোড়া স্যান্ডেল। তাও যদি সবাইকে দেওয়ার পর অবশিষ্ট কিছু থাকে। এক ঈদে বায়না ধরি, আমাকে শার্ট-প্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি আর একজোড়া স্যান্ডেলও কিনে দিতে হবে। বায়না শুনে আব্বার গর্জন- ‘কেন কিনতে হবে এতো সেট? কোন রাজপুত্তুর হইছো তুমি? অন্য মানুষের ছেলেরাতো এক সেট জামা কাপড়ই ঠিকমতো পায় না সেখানে কেন তোমার এতো লাগবে?’ পরদিন হয়তো আমার মনের মতো ঈদ হবে না এই অভিমান বুকে চেপে চোখ ভিজিয়ে কান্না করছিলাম- দেখি আমার মাথায় ছোট আপার হাত। ‘চোখ মুছে নে, এই নে- যা দৌড় দিয়ে গিয়ে স্যান্ডেল কিনে নিয়ে আয়। আব্বা যেন না দেখে!’ বলে হাতে গুঁজে দিল ৬০০ টাকা। নিজের পড়ার পাশাপাশি একটা ছোট টিউশনি করাতো আপা, বোধহয় সেবার আপার প্রথম টিউশনির মাইনে ছিল। 

ঈদের দিন নতুন পাঞ্জাবি- স্যান্ডেল পরে নামাজ থেকে ফিরে যখন বাসায় ঢুকি তখনো আব্বা বাসায় আসেননি। আম্মাকে সালাম করে তাঁর শাড়ির আঁচলে গুঁজে রাখা টাকা নিজের হাতে খুলে নিয়ে যে-ই আপাকে সালাম করতে যাবো অমনি আব্বা ঢুকলেন। ছোট আপার ইশারা ‘আব্বাকে সালাম কর আগে’। আব্বাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতেই বুকে জড়িয়ে আমার দিকে তাকাতেই তার চোখ গেলো আমার পায়ের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন- কই পেলাম নতুন স্যান্ডেল? বললাম- ছোট আপা তার জমানো টাকা থেকে কিনে দিয়েছে আব্বা। কোন জবাব না দিলেও বুঝতে পারলাম গলা জড়িয়ে এসেছে আব্বার, চোখ তার জলে টলমল। আব্বার কাছ থেকে সরে এসে ছোট আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম- আপা, আব্বা কাঁদছে!

আব্বা মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদছেন, আপা কাঁদছে, আম্মাও কাঁদছে। একেকজনের কান্নার রং একেক রকম। উৎসবের দিনে একজন পিতার কাছে সন্তানের আবদার মেটাতে না পারার লুকানো কান্না, একজন বোনের গচ্ছিত কষ্টের টাকায় একমাত্র ভাইয়ের আবদার পূরণের আনন্দের কান্না। একজন মা যার কান্নার রং দুই ধরনের, একদিকে সন্তানদের চোখের কান্না আর পাহাড়সম হৃদয়ের একজন স্বামী যে সন্তানের আবদার মেটাতে না পেরে নীরবে কাঁদে তার কান্না দেখে একজন স্ত্রী’র হাহাকার জড়ানো কান্না। আহ মধ্যবিত্ত সংসার!

ওই ঈদ-ই ছিল আব্বার সাথে কাটানো শেষ ঈদ। সেই ঈদের পর সাধ্যমত শখ মেটানো মানুষটার কাছে আর কোনদিন বায়না করতে পারিনি, চিরতরে চলে যাওয়া ওই মানুষটাকে আর কোনো ঈদে পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারিনি। কোনদিনও আর বলতে পারিনি- আব্বা আমার এই ঈদে ২ জোড়া জামা-কাপড়-পাঞ্জাবি-স্যান্ডেল লাগবে। দিতে হবে কিন্তু আব্বা।

আব্বাকে আজও চাইলেই বলতে পারি না- আব্বা এই ঈদে তোমার কি লাগবে বলো? আমি কিনে দেবো তোমায়। তোমার একমাত্র আদরের ছেলে আজ বড় হয়েছে আব্বা, ইনকাম করে, একা হাতে সংসার চালায়, শুধু তুমি বলো আব্বা, তোমার কী লাগবে। আব্বা জবাব দেয় না- নিশ্চুপ হয়ে কেবল হয়তো শোনে। সাড়ে তিন হাত জায়গার উপর গজিয়ে ওঠা ঘাসের বাতাসে হয়তো জবাব আসে- ‘বাবারে, আমার কিছু লাগবে না, শুধু তুই ভালো থাকিস সবসময়’।