বাবার নীল পাঞ্জাবি
বড় শখ করে বাবার জন্য একটা নীল পাঞ্জাবি কিনেছিলাম। আমার প্রথম রোজগারের টাকায়। সারা মাস রোজা রেখে কাজ করেছি, অনেক কষ্ট হয়েছে তবুও মনে আনন্দ ছিলো পরিবারের জন্য কিছু কিনতে পেরেছি। বেশি দাম দিয়ে কিনতে পারিনি তবে নীল পাঞ্জাবিটা দেখতে দারুণ ছিল। বাবাকে বেশ মানাতো। বাবাকে যখন বলেছিলাম- তোমার জন্য একটা নীল পাঞ্জাবি কিনেছি বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন। বাবার খুশি দেখে আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু ভাবছিলাম, কবে যে বাবার গায়ে এই নীল পাঞ্জাবিটা দেখবো! তর সইছিলো না আমার। বাবা-মায়ের জন্য কিছু কিনতে পারার আনন্দটা যে কেমন সেদিন আমি অনুভব করেছিলাম।
প্রতিদিন বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতাম কবে আসবে? মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম, বলো না মা, বাবাকে এই নীল পাঞ্জাবীটা পরলে কেমন লাগবে? খুব সুন্দর লাগবে তাই না! আমি নিশ্চিত বাবা যদি আমার পছন্দের এই নীল পাঞ্জাবিটা পরে তোমার সামনে দাঁড়ায় তুমি আবার নতুন করে বাবার প্রেমে পড়ে যাবে। মা মুখ টিপে হাসে আর বলে, তোর বাবা যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিল সেদিন ও নীল রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলো। আমাদের বাড়ির সবাই তোর বাবার নীল পাঞ্জাবী পরে আসা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলো, মেয়ে দেখতে এসে কেউ নীল পাঞ্জাবি পরে আসে এই প্রথম দেখলাম। আমার বান্ধবীরা তোর বাবাকে নিয়ে রসিকতা করেছিল। কিন্তু, আমি সেদিন তোর বাবাকে এক নজর দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কী যে সুন্দর লাগছিলো!
বিজ্ঞাপন
ছোটবোন সাদিয়াকে গিয়ে বললাম, দেখ এই নীল পাঞ্জাবি পরলে বাবাকে সেই লাগবে তাই না! সাদিয়া ভেংচি কেটে বললো, এহহ! কী একটা নীল পাঞ্জাবি আনছে তা নিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে। একটু পরপর সবাইকে ডেকে ডেকে দেখাতে হয়। মনে হয় বাবা আর জীবনে নীল পাঞ্জাবি পরেনি, এবারই প্রথম পরবে। মুখে না বললেও আমি জানি বাবার নীল পাঞ্জাবিটা সাদিয়াও খুব পছন্দ হয়েছিল।
যেদিন বাবার আসার কথা ছিল আমি সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করে বসেছিলাম। একটু পরপর বাবাকে ফোন দিচ্ছিলাম। কতদূর এসেছে, আর কতক্ষণ লাগবে,কখন বাবাকে দেখব, শক্ত করে একবার বুকে জড়িয়ে ধরব, অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। গাড়িতে কথা বলতে সমস্যা হয় জেনেও আমি বাবাকে বারবার ফোন করছিলাম। দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ করে বাবার ফোনটা বন্ধ দেখাল। বন্ধ তো বন্ধই। আমার খুব খারাপ লাগছিলো, ফোনটা বন্ধ হলো কেন? মা বললো হয়তো ফোনে চার্জ নেই। তুই কোনো চিন্তা করিস না, কিছুক্ষণ পরই চলে আসবে।
দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বাবার কোন খোঁজ নাই। অথচ ঢাকা থেকে আসতে এত সময় লাগে না। এতক্ষণে বাবার চলে আসার কথা। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ করে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। কলটা রিসিভ করলে ওপাশ থেকে একজন বললো, আপনি কি মোহাম্মদ আলীর ছেলে? আমি বললাম হ্যাঁ। তারপর লোকটা বললো, এই নম্বরে এসএমএস করে আপনাদের বাড়ির এড্রেসটা পাঠান, আমরা আপনাদের বাড়িতে আসছি। কথাটা বলার পরই লোকটা ফোন কেটে দিল। লোকটার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না, কে সে? কীসের জন্য ফোন করেছে? কিছুই বুঝলাম না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বোঝার জন্য আবার ফোন দিলাম রিসিভ হলো না। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফোনে একটা এসএমএস এলো ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনে আসুন। আপনার বাবাকে নিয়ে যান। কথাটা শুনে আমার বুকটা ধক করে উঠলো। পাগলের মতো মাকে ডাকতে শুরু করলাম। বিকেল পাঁচটার সময় অ্যাম্বুলেন্সে করে বাবাকে নিয়ে আসা হলো। বাস এক্সিডেন্টে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া নিথর দেহটাকে আমি একবার মন ভরে দেখলাম কিন্তু, তৃষ্ণা মিটলো না। শক্ত করে জড়িয়েও ধরেছিলাম কিন্তু আক্ষেপ মেটেনি। ঘর থেকে নীল পাঞ্জাবিটা এনে দিয়ে সবাইকে বললাম, বাবাকে নীল পাঞ্জাবিটা একবার পরাও। বড় শখ করে কিনেছি, অনেক কষ্টের রোজগারের টাকা। কম দামি হলেও পাঞ্জাবির রংটা দারুণ, বাবাকে খুব মানাবে। একবার পরাও না, আমি শুধু একবার দেখব, একবার শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরব।
আমার কথা কেউ শুনলো না। আমার নীল পাঞ্জাবিটা বাবাকে পরতে দিলো না। বাজার থেকে সাদা রঙের কাপড় কিনে এনে বাবাকে পরিয়ে নিয়ে গেলো, সঙ্গে আমার ঈদটাকেও নিয়ে গেল।