বাবার সঙ্গে স্মৃতি
সেই পাকিস্তানামলে আব্বার প্রিয় র্যালি সাইকেলটির পেছনে বসে ঈশ্বরদীর পার্শ্ববর্তী লালপুরের মাঝগ্রামে যাওয়া-আসার স্মৃতি এখন কেন জানি প্রায়ই মনে পড়ে। এখন যখন ভাবি আব্বার মতো এত সংগ্রামী, সাহসী ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন বলেই আমরা অনেক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পেরেছি, তখন নিজেকে গর্বিত মনে হয়। বিৃটিশ আমলে গ্র্যাজুয়েশন করা আমার পিতা (মরহুম ওসমান গনি) বহুমুখি প্রতিভার অধিকারি ছিলেন। ন্যায়-নীতি আর আদর্শ ধরে রেখে চলতে গেয়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি হয়ত অনেক ধন-সম্পদের মালিক হতে পারেননি; কিন্তু যা রেখে গিয়েছিলেন সেটুকুও ছিল আমাদের জন্য সম্মানজনক।
আব্বার সেই পরিশ্রমের ফসল মাঝগ্রামে আমাদের জমি, বাগান আর এক একরের একটি পুকুর ঘিরে ছিল আব্বার আরেক জীবন। স্কুলের শিক্ষকতা শেষ করে বাড়িতে ফিরে প্রায়ই তিনি যেতেন মাঝগ্রামে, সঙ্গে আমি। জাল ফেলে পুকুরে মাছ ধরা। তাজা কৈ, জিওল ইত্যাদি মাছ খালৈতে ভরে দাদির জন্য একটি বড় মাটির পাত্রে কিছু মাছ রেখে বাকিটা বাড়ির জন্য নিয়ে আবার সাইকেলে রেললাইনের পাশ দিয়ে ঈশ্বরদী ফিরে আসা। সাইকেলের চাকার সঙ্গে ডায়নামো লাগানো ছিল। এটা থেকে তৈরি বিদ্যুৎ সামনের লাইটটাকে জ্বলতে সাহায্য করতো, অনেক আলো হতো। সেই আলোতে রেললাইনের পাশ দিয়ে ছোট-ছোট পাথর এড়িয়ে অতি সাবধানে সাইকেল চালিয়ে রাত আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতেন। রাতের নিরাপত্তার জন্য আব্বার সঙ্গে তাঁর প্রিয় রিভলবারটি থাকতো।
বিজ্ঞাপন
সঙ্গে আনা এই কৈ-জিওল মাছ আম্মা বড় মাটির পাত্রে দিতেন। তখন তো ফ্রিজের কারবার ছিল না। মাটির পাত্র থেকে নিয়ে রান্না হতো। সপ্তাহজুড়ে মজা করে তাজা মাছের ঝোল খাওয়া হতো। এ ধরনের অনেক আনন্দের সঙ্গে আমাদের আব্বার আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের স্পর্শ ছিল অনেক অনেক বেশি। এসব এখন মনে পড়লে আমি বিমোহিত হয়ে পড়ি। আমাদের মাথার এই মজবুত ছাতাটি হারিয়ে আমরা এতিম হয়েছি ১৯৮৬ সালের ২৯ শে জুন।
বৃষ্টি হলে মাঝগ্রামে বাড়ির সামনের স্কুল মাঠটিতে কৈ-জিওল মাছ উঠে আসতো। কিলবিল করে ঘাসের ভেতর চলাচল করতো। কয়েকজন চাচাতো ভাইসহ এগুলো হাত দিয়ে ধরতে যেয়ে কত কাঁটা খেয়েছি তার হিসেব নেই। জ্বর এসে যেত। সেই জ্বর দাদির দেয়া হারবাল চিকিৎসায় পরদিনই ভালো হয়ে যেত। কিশোর বয়সের এসব স্মৃতি অনেকের ভাগ্যে জোটেনি।
নব্বইয়ের দশকে মোবাইল ফোন আসার পর তো এ ধরনের আনন্দের সবকিছুই এই প্রজন্মের কিশোর-তরুণরা বিসর্জন দিয়েছে। তারা হয়ে পড়ছে এক ধরনের অচেতন, অনেকটা অসামাজিক। কেউ কারো খোঁজ নিচ্ছে না। যোগাযোগ বলতে মাঝে মাঝে মুঠোফোনে হাই-হ্যালো। দাদা-দাদি, নানা-নানি আর বাবা-মার সঙ্গে সেই মনখুলে কথা বলা, হাসি-আনন্দ অনুভব করা, মুরুব্বিদের ঠাট্টা করে কথা বলার প্রচলন এখন নেই বললেই চলে। বয়স্করাও এখন ফেসবুকে ব্যস্ত। অনেক বেশি আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি।
বিগত কোভিড-১৯ এর হামলায় গোটা মানবজাতি ধরাশায়ী হয়েছে। এ মহামারিতে আক্রান্ত ঘনিষ্ঠজনদের পাশে দাঁড়াতেও মানুষ ভয় পেয়েছে। হাজারো মানুষ মারা গেছে এই ভাইরাসে। দূরত্ব তৈরি হয়েছে মানুষ-মানুষের মাঝে। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আন্তরিকতা, হৃদয়ের অনুভব। এর বাইরেও মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়েছে অনেকগুণ। ভোগবিলাসী মানসিকতায় আক্রান্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনও একে-অন্যের খবর রাখে না। নিজের অগ্রগতি নিয়েই ব্যস্ত। সামাজিক শৃংখলা নেই আগের মতো। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষদের অপরিসীম অবদান, ত্যাগ আর গঠনমূলক চিন্তা ও কাজের যে উজ্জ্বল উদাহরণ তারা রেখে গেছেন সেসব থেকে আমরা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহি হই না। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক শিষ্টাচার এখন বিদায় হওয়ার পথে।
আমরা চাই পরিচ্ছন্ন হোক সমাজ। ফিরে আসুক সেই দাদা-নানা আমলের মানসিকতার সমাজজীবন। কারণ আমার আবার ইচ্ছে করে আব্বার সেই র্যালি সাইকেলের পিছনে চড়ে গ্রামে যেতে। যেটার ডায়নামো থেকে আলো ছড়াবে, অন্ধকার ভেদ করে রেললাইনের পাশের সরু পথটি দেখাবে সুখ-শান্তিতে ঘেরা গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য।
ঈশ্বরদী, পাবনা।