ছবি: প্রতীকী

জমাট বর্ষাকাল। আকাশে ঘন কালো মেঘের আনাগোনা। থম মেরে আছে চারপাশ। যেকোন সময় তুমুল বর্ষণ শুরু হবে। নাজমা বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হতে লাগল। আজকে তার ছেলের ঢাকা থেকে বাড়ি আসার কথা। এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কীভাবে আসবে। তার উপর গ্রাম্য রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা। মোষের গাড়ি ছাড়া আর কিছুই রাস্তায় চলে না। এসব ভাবতে না ভাবতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। মনে হচ্ছে আসমানের ডালা ভেঙে পড়বে। ফোন করেও খোঁজ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাড়িতে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। কথা বলতে হলে বাড়ি থেকে অনেক দূরে যেতে হয়। এই ঘোর বরষার দিনে তা কস্মিনকালেও সম্ভব না। রঞ্জুকে বলাই আছে মোষের গাড়ি নিয়ে গঞ্জে থাকতে। বেলায়েত সেই গাড়িতে করেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু বৃষ্টির যে ধাঁচ তাতে রঞ্জু এখন মোচড় দিয়ে না বসে। নাজমা বেগম আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করতে লাগলেন।

দেশ উন্নত হয়েছে কিন্তু সুবাসপুর এখনও অন্ধকারেই রয়ে গেছে। ভোটের সময় সবাই আশ্বাস দেয় হ্যান কারেগা ত্যান কারেগা কিন্তু ভোট শেষ হলেই সবাই আখের গোছাতেই ব্যস্ত। অসহায় রাস্তা বা গ্রাম্য নিন্মবিত্ত মানুষের কথা কেউ মনে রাখে না। নেতারা লম্ফ দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পগার পার।

টিনের চালে অনবরত বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা। নাজমা বেগম কুরআন শরীফ নিয়ে বসলেন। বৃষ্টির সময় তিনি বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করেন। নবী বলে গেছেন, বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। তিনি প্রাণ উজার করে বেলায়েতের জন্য দোয়া করেন। স্বামীর জন্য দোয়া করেন। নিজের জন্য চাইবার তেমন কিছু নেই তার। আল্লাহ্‌ তাকে যা দিয়েছেন এর থেকে বেশি কিছু এক জীবনে তিনি চাননি। বাইরে রঞ্জুর গলা শোনা গেল।

: চাচি, ও চাচি

নাজমা বেগম বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

: কী রে রঞ্জু যাবি কখন?

: চাচি যেমনে বৃষ্টি হইতেছে মনে হয় না বেলায়েত ভাই আর আইব শহর থেইকা।

: হ, তোরে কইছে। পোলাডা আমার গঞ্জে আইসা দাঁড়াইয়া থাকব। উষ্মা জড়ানো কণ্ঠে জবাব দেন নাজমা বেগম। তুই তোর লস্কর আর পাঠানরে নিয়ে বেলাবেলি বাইর হ। নাইলে দেরি হইয়া যাইব।

লস্কর আর পাঠান হলো রঞ্জুর দুইটা মোষের নাম। যেমন নাম তেমন গায়ের শক্তি। কীসের বৃষ্টি কিসের কাদা। গ্রামাঞ্চলে এর চেয়ে বড় বাহন আর কিছু নাই।

রঞ্জু কিছুটা অবনত গলায় বলল, টাকার ব্যাপার না চাচি। এমন বাদলার দিনে লস্কর আর পাঠানরে কাদার সমুদ্দুরে নামাইতেও মায়া লাগে।

: সোনা বাপ আমার। কষ্ট হইলেও যা। নাইলে পোলাডা আমার ক্যামনে আসব।

রঞ্জু ডান দিকে মাথা কাত করল যার উত্তর হয় হ্যাঁ আমি যাচ্ছি।

বেলায়েত বাড়িতে আসল রাত দশটারও পর। তখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। নাজমা বেগম ছেলের মাথা মুছতে গিয়ে আহা আহা করতে লাগলেন। কেন শুকিয়ে পাটকাঠির মতো হয়ে গেছে বারবার তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। গোসলের জন্য গরম পানি করে দিলেন। খাবার পাতে বাহারি ভর্তা, শিং মাছের ঝোল, সরপুঁটি ভাজা, কালোবাউসের চচ্চড়ি, কালা ভুনা, কবুতরের মাংশ আরও কত কী! মনে হচ্ছে বেলায়েত একবেলা খেয়েই আবার ঢাকা রওনা হবে। বেলায়েত মায়ের কাছে ঢাকার গল্প করতে করতে খেতে লাগল।

খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে এসেছে। বারান্দায় জলচৌকিতে বসল বেলায়েত। মুখটা একটু গম্ভীর। ব্যাগের ভেতর থেকে পাঞ্জাবি আর শাড়ি বের করতে করতে বলল,

: মা শাড়ি পছন্দ হইছে তোমার?

: হ অনেক সুন্দর। তয় তোর আব্বার পাঞ্জাবিটা কেমন জানি!

: কেমন মা?

: কেমন ম্যাটম্যাটা রঙ।

: আব্বা পছন্দ করবে না?

: করব না আবার। ছেলে পাঞ্জাবি আনছে সেটা যাই হোক পছন্দ করবে।

: মা, তুমি জিগাও না আব্বার পছন্দ হইছে কিনা।

: তুই জিগাইতে পারস না?

: আমার সাথে তো আব্বা কথা বলে না। তুমি জিজ্ঞেস কর। তুমি তো রোজই কথা কও।

হঠাৎ মিহি নীরবতা নেমে আসে মা ছেলের মাঝে। নাজমা বেগম আঁচলে চোখ মোছেন। উঠোনের মাঝ বরাবর সোলাইমান খাঁর কবর। কবরের মাঝে এক গুচ্ছ কামিনী ফুলের গাছ। গন্ধে মম করছে পুরো বাড়ি। আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। চারপাশ কেমন নিরব, নিঃসীম, নিঃস্পৃহ।
 
সোলাইমান খাঁ এক জীবনে কিছুই করে যেতে পারেননি স্ত্রী পুত্রের জন্য। পরহেজগার লোক ছিলেন তিনি। আল্লাহ্-এলেম নিয়ে কেটেছে তার পুরো জীবন। নিজের ছেলে বা বউয়ের শখ পূরণ তো দূরের কথা সারাজীবন দুবেলা অন্য যোগাড় করতেই তিনি হিমশিম খেয়েছেন। বিয়ের পরে তিনি অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন নাজমা বেগমের কানের দুল বানিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু রসুলপুর সদরে যাওয়ার সময় তার সেই টাকা পকেটমার হয়ে যায়। তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো বাড়িতে ফিরে নাজমা বেগমকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। নাজমা বেগম এক জীবনে এত ভালো একজন মানুষকে পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। তীব্র অভাববোধ কখনোই তাকে ছুঁতে পারেনি।

দূর গাঁওয়ের এক মসজিদে ইমামতি করতেন সোলাইমান খাঁ। পাশাপাশি মক্তব্যে ছোট বাচ্চাদের কুরআন পড়াতেন। মাস শেষে যে কটা টাকা পেতেন তাই নিয়ে ছুটে আসতেন বাড়িতে। বেলায়েতের স্কুলে অনেক সময় মাইনের টাকা বাঁকি পড়ে যেত। তাকে পরীক্ষায় বসতে দিত চাইত না শিক্ষকরা। তিনি গিয়ে মাষ্টারদের হাতে পায়ে ধরতেন।

সেবার ক্লাস ফাইভে থাকতে স্কুল পর্যায়ে হামদ ও নাথ বিভাগে প্রথম হয়ে বেলায়েত উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হলো। সমস্যা হলো বেলায়েতের কোনো পাঞ্জাবি নেই। সে তার বাবার কাছে এই প্রথম একটা পাঞ্জাবির জন্য আবদার ধরল। কেঁদেকেটে একাকার। সোলাইমান খাঁর বুকের ভেতর হুহু করে উঠল। এই জীবনে ছেলে তার কোনকিছুই আবদার করেনি কখনো। অন্তত এই পাঞ্জাবিটা দিতে না পারলে তিনি মনঃকষ্টে মরে যাবেন।

মাসের অর্ধেক তখন। সোলাইমান খাঁ মসজিদ কমিটির সভাপতির কাছে অগ্রিম বেতন চাইতে গেলেন। বিগলিত কন্ঠে কাকুতি মিনতি করলেন। কিন্তু কাজ হলো না। অনেক পরিচিতজনের কাছে ধারদেনা চেয়েও ব্যর্থ হলেন। সবাই জানে সোলাইমান খাঁর আর্থিক অবস্থা খারাপ। তাই তাকে ধার দেয়ার কোন মানুষ নেই। আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে সোলাইমান খাঁ একটা অন্যায় কাজ করে বসলেন। মসজিদের দান বাক্স থেকে কিছু টাকা নিয়ে নিলেন। ভাবলেন বেতন পেলে সেটা পূরণ করে রাখবেন। তারপর সেই টাকা দিয়ে তিনি বেলায়েতের জন্য একটা পাঞ্জাবি বানালেন। লাল টুকটুক পাঞ্জাবি। তিনি ভাবতে লাগলেন তার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। অনেক নাম করবে। আরও কত কি। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তিনি বাড়ি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন।

এলাকার কেউ একজন সোলাইমান খাঁর পুরো ব্যাপারটা টের পেয়ে মসজিদ কমিটির কাছে ফাঁস করে দিল। কাজের কাজ যা হবার তাই হলো। সেদিন রাতেই বিচার বসল মসজিদে। নগদ তহবিল তছরুফের দায়ে বিশ্বস্ত ও পরহেজগার সোলাইমান খাঁর চাকরি চলে গেল। পরদিন ভোরে তার মসজিদ ছাড়ার নোটিশ হলো। একজন ইমামের চুরির অপরাধে চাকরি চলে গেছে এটা কীভাবে তিনি তার পরিবারকে জানাবেন? গ্রামবাসীকে বোঝাবেন? সারারাত সোলাইমান খাঁ বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলেন। ভোররাতে ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে নিভৃতে, নিরবে তার রুমের মধ্যে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেলেন। মসজিদের পাশে বহেরা গাছটাতে শুধু একটা রাতচরা পাখি বিনবিনিয়ে কাঁদতে লাগল।

তখনও বর্ষাকাল। ঝুম বৃষ্টিতে প্রায় তলিয়ে গেছে পুরো গ্রাম। এমন এক সকালে বাড়িতে সোলাইমান খাঁর লাশ এল। সাথে সোলাইমান খাঁর ছোট্ট পুটলি আর বেলায়েতের লাল টুকটুকে পাঞ্জাবী। নাজমা বেগম কর্তব্যহীন হয়ে পড়লেন। জীবনের এমন এক আকস্মিক বিচ্ছেদে তার মাথার নিউরন ঠিকমত কাজ করল না। আকাশের মেঘগুলো বুক চাপড়ে সব জল ঢেলে দিল। নাজমা বেগম ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন বারান্দায় রাখা খাটিয়ার দিকে। বেলায়েত বাবার পাশে রাখা পুটলিটা নেড়েচেড়ে দেখছে। আড়চোখে দেখছে পাঞ্জাবিটাও। সে কি একটু পাঞ্জাবিটা ছুঁয়ে দেখবে? যে পাঞ্জাবি পরে উপজেলায় তার অনুষ্ঠানে যাবার কথা। তার বাবার মুখটা খুলে রাখা হয়েছে। মানুষজন এসে দেখছে। বেলায়েত একবার নিথর দেহে বসে থাকা মায়ের কাছে যায় আবার এসে বাবার মুখটা দেখে। সে কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাদের বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। উঠোনে শামিয়ানা টাঙিয়ে কবর খোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে যাচ্ছে কবর। কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে পানি ওঠা কবরেই শুইয়ে দেয়া হলো সোলাইমান খাঁকে। সাদা কাফন ঘোলা পানিতে ডুবে যেতে লাগল। ডুবে যেতে লাগল সোলাইমান খাঁর মুখ। ডুবে যেতে লাগল এই জীবন জগতের সকল বন্ধন, মায়া, মোহ। এরচেয়ে করুণ দৃশ্য হয়তো পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আহারে কি দোর্দণ্ড জীবনের যবনিকাপাত! আহারে সোলাইমান খাঁর সংসার! কী নিয়ে বাঁচবেন নাজমা বেগম? কীভাবে মানুষ করবেন বেলায়েতকে? 

এরপর বহুদিন গড়িয়েছে। জীবন নাকি যতটা কেড়ে নেয়, দেয় ঢের বেশি। হয়েছেও তাই। বেলায়েত পড়াশোনা শেষ করে একটা সরকারি চাকরি করে। মাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মা চায় প্রতিদিন রাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে কবরে ফুটে থাকা ওই কামিনি ফুলকে স্পর্শ করতে। জীবনের না বলা সমস্ত অনুযোগ, অভিযোগ তার স্বামীকে বলতে। অনেক গল্প বাকি এখনও। আটপৌরে অষ্টাদশীর গল্প! আরও কত কী! সব কি ছেলেকে বলা যায়!

মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। মা ছেলে বসে আছে বারান্দায়। নিকশ কালো আঁধারে কেউ কারও মুখ দেখাতে চান না। নাজমা বেগম সব আঁধার ভেদ করেও তাকিয়ে আছেন কামিনি ফুলের দিকে আর বেলায়েত আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, আরশের নিচে যার মাথার উপর বাবার ছায়াটুকু নেই সে জানে বাবা কী জিনিস। তার চোখ ভিজে উঠছে বারবার। এখনই তুমুল তোড়ে আবার বৃষ্টি নামবে। বেলায়েত বিড়বিড় করে পড়তে লাগল, “রাব্বির হাম-হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা।”

ডেপুটি ম্যানেজার, অ্যাডভারটাইজমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ।