ছবি: প্রতীকী

বাড়ির ছোট ছেলেরা সব সময়ই একটু বেশি দুষ্ট হয়, আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি রাগী ছিলাম। কারো কথা শুনতাম না, সারাটাদিন শুধু দুষ্টামি করে বেড়াতাম। আমার বাবাকে- কোনদিন আপনি থেকে ভালোবেসে তুমি বলে ডাকতে পারিনি, কারণ আমি দুষ্ট হলেও বাবাকে বেশ ভয়ই পেতাম। ছোট সময় দেখতাম অনেকদিন পর পর ঢাকা থেকে বাবা আসতেন। বাবা বাড়িতে আসা মানেই শক্ত টোস্ট বিস্কুট, তবে সে সময় সেটাই অনেক ভালোলাগতো। ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে তেমন কিছু করতে পারেননি। তবে তিনি একটা জিনিস করেছেন- সেটা হলো আমাদের মানুষ করেছে।

জীবনে অনেক পরিশ্রম করেছেন তিনি, হয়তো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটা চালাতে কতদিন তার না খেয়েও কাটাতে হয়েছে। খুব শক্ত-পোক্ত মানুষ ছিলেন, কোনদিনও কারো সঙ্গে মনমালিন্যও হয়নি। তবে রাগটা ছিল বেশ।

আমরা তিন ভাই, এক বোন, মাকে দেখতাম কষ্ট করে হলেও সবকিছু ম্যানেজ করে নিতো। কারণ টেলিফোনহীন সময়টা মাসের শুরুর দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো কবে বাবা আসবে। এক ব্যক্তির টাকায়ই তো এই সংসারটা চলে, হয়তো কোনো কোনো সময় ২-৩ মাস হয়ে যেত, আর তখন মাকেই পরতে হতো বিপদে। কারণ সংসারের বোঝাটা তখন আমরা বুঝতাম না।

বাবার বয়স এখন ৭৫ হবে হয়তো, আমি জানি না। বাবার মুখে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা ঢাকায়ই ছিলেন। তবে যুদ্ধ করেননি, খেদেছেন। তাহলে হবে হয়তো ৭৫ই। এর বেশিরভাগ সময়ই পার করে দিয়েছেন জীবন সংগ্রামে।

ভাই-বোনের মধ্যে আমিই সবার ছোট, আমিও এখন টাকা রোজগার করতে পারি। এখনও দায়িত্বটা বাবার ওপরেই রয়ে গেছে, কারণ তিনি একজন বাবা, তিনি আমাদের বটবৃক্ষ। বাবার বয়স এখন ৭৫ তবে শক্তিটা যেন আশির ঘরে চলে গিয়েছে। হয়তো কোনো এক সময় অনেক রাগ হতো বাবার প্রতি যে জীবনে তেমন কিছু করে দিতে পারেননি আমাদের। কিন্তু আজ বুঝি যা করেছে হয়তো আমরা তা পারবো না। সেসময় তারা আমাদের বোঝাতেন সঠিক সময়, সঠিক জিনিস, সঠিক মাধ্যম। হয়তো বুঝতাম না, রাগের তোপে উড়িয়ে দিতাম, কিন্তু আজ? নিজেই বাবার কষ্টের সময়টা বুঝি।

জীবন চলে তার নির্দিষ্ট গতিতে, হয়তো কেউ তার মনের মতো করে চালাতে পারে আবার কেউ চালাতে গিয়ে জীবনের মানেই হারিয়ে ফেলে। আমার বাবা খুব রসিক মানুষ, দোকানদার মানুষতো তাই (মানে ব্যবসায়ী আর কী!), তাও আবার কসমেটিকস্ ব্যবসায়ী। তার অনেক পরিচিত মুখ, অনেকের সাথে সখ্যতা হয় প্রতিদিন, আজও চলছে তেমন করেই। তবে আজ তার বুকে ব্যথার পাহাড় হয়ে কালো মেঘ হয়ে থাকে। আমার বড় ভাই ৩৯ বছর বয়সে স্ট্রোক করে মারা যাবার পর থেকেই তার এ অবস্থা। কারণ পুত্রের শোক গত তিন বছরেও ভুলতে পারেননি আমার বাবা। 

প্রতিদিন একা বসে চোখের কোণে পানি ফেলেন, কাউকে বুঝতে দেন না পুত্র হারানোর শোক। এখন বাবা একদিন ভালো থাকলে আরেকদিন খারাপ থাকেন। শরীরে বেঁধেছে নানা রোগ, এখন অবশ্য ওষুধের উপরই থাকতে হয়। এখন খুব ভয় হয় কখন বাবার শরীরটা খারাপ হয়ে যায়। এক রাত ঘুম হলে আরেক রাত জেগে কাটাতে হয় বাবাকে। তবুও এই বয়সে এসে দোকানে ঠিকই বসেন। 

বাবা আমাদের সব ভাই-বোনকে অসম্ভব আদর করতেন, কো দিন গায়ে হাত তোলেননি, বকাও দেননি। আজ সেই মানুষটা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বাড়ি যাওয়া হয় আমার, কারণ আমিও ইট পাথরের শহরে কর্মজীবী। রাত যতই হোক বাড়িতে গিয়ে বাবার খবরটাই প্রথমে নিয়ে থাকি মনের অজান্তে। প্রতি রাতে মাকে ফোন দিয়ে বলি বাবা খাইছে, বাবা কী খাইছে? ঠিক মতো ঔষুধ খায় তো? তবুও প্রিয় বাবাকে কত ভালোবাসি তা বলাই হয় না।

ঈদে বাবার জন্য নতুন পাঞ্জাবির কাপড়, নতুন জুতার কথা বললে বাবা এখনও বলেন, আমার কিছু লাগবে না তোমরা কিছু কিনে নাও। আজও হয়তো বুঝে উঠতে পারি না আমাদের প্রতি তার ভালোবাসাটা কতখানি। সেই শক্তিশালী মানুষটি সময়ের ঘূর্ণিপাকে আজ বৃদ্ধ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার একটাই পরিচয় আমার কাছে, তিনি আমার বাবা। মাথার উপরে ছাদ থাকলে হয়তো সূর্যের তাপ গায়ে লাগে না, কিন্তু সারাটা জীবন আমার মাথার ওপর আপনিই ছায়া হয়ে আছেন প্রিয় বাবা।