ছবি: প্রতীকী

‘চিন্তা করিস না বাবা, আমি আছি তো, এখনো মরি নাই’! আব্বা, আপনার বলা এই বাক্য শুনলেই আমার পাহাড় সমান দুঃচিন্তা কষ্ট, সব দূর হয়ে যেত নিমেষেই। আজ কতদিন, কত বছর হয়ে গেল আপনার এই অসম্ভব শক্তিশালী বাক্য শুনি না। কতদিন আপনাকে আব্বা বলে ডাকতে পারি না। কতদিন আপনার নম্বর থেকে ফোন আসে না। একসময় মনে হতো আপনি ছাড়া চলতেই পারবো না। অথচ আপনাকে ছাড়াই বেঁচে আছি কী অদ্ভুতভাবে।

আব্বা, আপনার নিশ্চই মনে আছে যে আপনার প্রচণ্ড রকম সিগারেট খাওয়া আমি অপছন্দ করতাম। তাই আপনিও আমার সামনে সিগারেট খেতেন না। আমি আপনার এই লুকিয়ে সিগারেট খাওয়াটা বেশ উপভোগ করতাম। মনে হতো আপনি আমার ছেলে। আর আমি আপনার বাবা। কেন যেন ছোটবেলা থেকেই আমি আপনার ও মায়ের খুব বাধ্যগত সন্তান হয়েছিলাম। যে কারণে আমাকে আপনি ভালোবাসতেন অনেক বেশি। পরিচিত সবাইকে বলে বেড়াতেন- ‘আমার এই ছেলে সবার থেকে আলাদা, সে কখনো মিথ্যা বলে না, কাউকে ঠকায় না’। আরও কত রকম প্রসংসা যে করতেন, তার ইয়ত্তা নেই।

আমি কখনো আপনার প্রশংসা করতে পারিনি। একটা জড়তা কাজ করতো। তবে শাষণ করতাম আপনাকে। আপনি প্রচণ্ড কাজের ক্লান্তি ও সংসারের নানারকম সংকটে অতিষ্ঠ হয়ে মাঝে সাঝেই মাকে বকাঝকা করতেন। আমি সেটা নিতে পারতাম না। আপনাকে না বুঝেই সব সময় মায়ের পক্ষ নিয়ে থেমে যেতে বলতাম।

আপনি থাকাকালীন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে পারিনি একটুও। সব ভালোবাসা মায়ের জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু আপনি চলে যাবার পর থেকেই বুঝতে পারছি যে আপনাকে কতটা ভালোবাসতাম। অথচ কখনো তা প্রকাশ করা হয় নাই। নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হয় এখন। এখন আমিও তো বাবা হয়েছি তাই বুঝতে পারি প্রতিটা বাবা তার সন্তানের জন্য কতটা দরদ ধারণ করে বুকে। বুঝতে পারি কতটা ত্যগ স্বীকার করে সারাজীবন। অথচ আমরা বেশিরভাগ সন্তানেরা কেবল মাকে ভালোবাসা প্রদর্শন করি, বাবাকে না।

আব্বা, আমাদের একসময় অসহ্য রকম দুর্দিন কেটেছে। অসহায়ত্ব, সংকট, অভিযোগ কত রকম হয় তা খুব কাছ থেকেই দেখেছি। সে সময়ে সামান্য আয় দিয়ে আমাদেরকে নূন্যতম প্রয়োজন মেটানোর কী অসাধ্য প্রচেষ্টা দেখেছি আপনার, যা এখন ভাবতে গেলে শিউরে উঠি।

আপনি তো আমার দেখা নায়কদের একজন। যিনি নিজের সহায় সম্পত্তি সব কিছু নদীর গ্রাসে ও আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে হারানোর পরও সাতজন সন্তানকে খাইয়ে-পরিয়ে বড় করেছেন। একটা জীবন স্রোতের কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়িয়েছেন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। তবু কারো কাছে মাথা নত করেননি। প্রচন্ড জেদি একজন মানুষ ছিলেন আপনি। যে কারণে নিজের অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে আপনাকে। কেবল ব্যক্তিত্ব আর গাম্ভীর্য রক্ষা করেছেন তুমুল যত্নে। আর রক্ষা করেছেন সন্তানের অধিকার। সন্তানের ভালোবাসা। 

আমার সামান্যতম সাফল্যেও আপনি খুশিতে শিশুদের মতো হাসতেন, উল্লাস করতেন। বই পড়া আর আমার সাহিত্য চর্চা নিয়ে আপনার আগ্রহ ছিল ব্যপক। আমি তো পাঠের অভ্যাস আপনার থেকেই পেয়েছি। আপনি চাইতেন আমি যেন একসময় আপনার সংগ্রামী জীবন নিয়ে কিছু লিখি। আব্বা, আপনার জীবনের অদ্ভুত অথচ বর্ণালী রং তো আমার কলমে সঠিকভাবে ফুটে উঠবে না। তাই লেখার দুঃসাহস করি না। যদি বেঁচে থাকি তবে এক সময় লিখবো।

কিন্তু আপনাকে ভালোবাসি এই কথাটা তো আর বলার সুযোগ নেই আব্বা। এখন আমার নানা রকম সংক,ট অসুস্থতা ও বিপদে আপনার অভাব অনেক বেশি উপলব্ধি করি। ভীষণ কষ্ট হয় যখন দেখি আপনি নেই। চারপাশ অন্ধকার লাগে। শুধু একটা বাক্য শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি। আমার প্রতি আপনার সেই সেরা বাক্য-‘চিন্তা করিস না বাবা, আমি আছি তো, এখনো মরি নাই’।

ইতি,

আপনার চোখে সেরা ও বাধ্য সন্তান

আহমাদ স্বাধীন।