বাবা আমাদের জন্য হাসি কিনে আনেন
প্রাইমারিতে পড়ার সময় একবার স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন- তোমার বাবা কী করে? আমি অস্ফুটে হাসিমুখে বলে দিলাম, আমার বাবা কাজ করে আমাদের জন্য হাসি কিনে আনে। কী কাজ করে? স্যারের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। আসলেই তো আমার বাবা কী কাজ করে? এর আগে জানতাম না আমার বাবা কী কাজ করে। এতোদিন আম্মার মুখে শুনেছি, আমার বাবার কাজ একটাই আমাদের জন্য হাসি কিনে আনা।
সেদিন থেকে ভাবতে শুরু করলাম, আমার বাবা কীভাবে হাসি কিনে আনে? কোন কাজ করে? দেখেছি আমার বাবা প্রতিদিন ফজর হলে নামাজ পড়ে বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। আমার বাবা চৈত্র মাসের কাঠফাঁটা রোদে ঘাম ঝরান। বৃষ্টিতে ভিজে ধান রোপন করেন। আমার বাবা আষাঢ়ের তুফান, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, শ্রাবণের অগ্নিঝরা বৃষ্টি বর্ষণ, পৌষের শীত ডিঙিয়ে, শত বাঁধা পেরিয়ে আমাদের জন্য হাসি কিনে আনেন গভীর দরিয়া বঙ্গোপসাগর থেকে। তিনি কূল পেরিয়ে সমুদ্রের অকূলে চলে যান উহুদ পাহাড়ের ন্যায় স্বপ্ন নিয়ে। যে স্বপ্ন কি না নিজের স্বার্থে নয়, সেই স্বপ্ন আমাদের মুখে এক টুকরো হাসি ফোটাবার তাগিদে।
বিজ্ঞাপন
প্রায় সময় আমাদের বাড়িতে বন্ধুরা আসে, গল্প-গুজব করি, হাসি-আড্ডা হয়। ঘুরি-ফিরি। কিন্তু, আমার বাবাকে দেখেছি তার কোনো বন্ধু নেই। কোথাও ঘুরতে গিয়েছেন তাও দেখিনি। প্রতিদিন নিয়ম করে একই কাজ করতে দেখেছি। চাল-ডাল কেনার জন্য নিয়মিত শুধু বাজারে যেতে দেখেছি। মাঝেমধ্যে দেখেছি, এলাকার খোকাবাবুর দোকানে একটু লেবু দিয়ে চা খেতে। খোকাবাবুর দোকানে একটা টিভি আছে। জেনারেটর দিয়ে কোনমতে চলে আর কী! বাবাকে দেখেছি, সেখানে একটু আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের খেলা দেখতে। অথচ, তিনি কোনো মেসি নেইমারের নাম জানেন না, দেখেন শুধু। সবাই দেখে একটু দেখলে মন্দ কী! কিন্তু, তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখায়। রাত্রে একটু ঘুমাতে গেলেই চোখে ঘুম আসেনা। মাথায় চলে আসে, তার মেট্রিক পাশ করা মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে।
রমজানের ঈদের পর বন্ধু নাবিল এলো বাড়িতে। আব্বা ঠিক তখনই দাদুর কবর জিয়ারত করে এলেন। আব্বার গায়ের দিকে খেয়াল করে দেখলাম আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগের সেই একই পাঞ্জাবিটা। পরনে একটা সাদা লুঙ্গি। যা রমজানের এক মাস আগেই আপু কিনে দিয়েছিল, পুরনো লুঙ্গিটা ছিঁড়ে গিয়েছে বলে। বন্ধু নাবিল দেখে বলে উঠল, আংকেলের পাঞ্জাবিটা গতবছর ঈদেও দেখেছি পরতে। কেন? এই বছর কেনেননি? তখন, আব্বা মাথা নিচু করে চলে এলেন না শোনার ভান করে। কারণ, তখন আব্বার কোন উত্তর ছিল না! আব্বার জন্য আমার ভীষণ লজ্জা লাগলেও আমার গায়ের পাঞ্জাবিটা আব্বা কিনে দিয়েছেন নিজে কিছু না কিনে।
আব্বার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। ভাবি, তার ঋণ কীভাবে শোধ করবো? যা শোধ হবার নয়। বরং তার জন্য আমি প্রার্থনাই নত হই, দোয়া করি। আমার বাবা যেন বেঁচে থাকেন পৃথিবীতে শত বছরের হায়াত নিয়ে। রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানী সা'গিরা।
সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ