বাবা, আমি তোমার কলিজা ছিলাম
বাবা! তোমার বুকটাই নয় শুধু বরং তোমার গলার উপর দিয়ে পা তুলে দিয়ে ছাড়া আমার ঘুমই আসতোনা। তোমার নাক ডাকা শব্দে আমি ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠতাম! মা তোমাকে ঠেলে উঠিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘মেয়ে ভয় পায়, নাক ডাকা বন্ধ করেন’। আমি আবার তোমাকেই জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম বাবা।
সকাল হলে তোমার পিছুপিছু ঘুরে বেড়ানোটাই ছিলো আমার একমাত্র কাজ। রোজ ঘুম থেকে উঠে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে মেপে দেখতাম আজ কতটুকু বড় হয়েছি, কবে তোমার কোমর পর্যন্ত হবো এই অপেক্ষায় দিন গুণতাম। আমার সহস্র উদ্ভট প্রশ্নের একমাত্র উত্তর স্থান তুমি ছিলে বাবা।
বিজ্ঞাপন
আমি এখনো চোখ বন্ধ করে নিজেকে তোমার চাদরে মোড়ানো দেখতে পাই। শীতের সময় তোমার চাদরে আবৃত আমার ছোট্ট মুখটুকু বাইরে রেখে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে তুমি। টং দোকানে বাসি পাওরুটির ঘ্রাণ আর তোমার গরম চায়ে চুমুকের শব্দ আমি এখনো খুব কাছে থেকে অনুভব করি।
যত প্রয়োজন আর যত গুরুত্বপূর্ণ কাজেই তুমি বাইরে যেতে, সাইকেলের পেছনে বসিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়াটা ছিলো তোমার রোজকার অভ্যাস। কোথাও যাওয়ার সময় এলেই সেই পরিচিত ডাক দিয়ে বলতে, ‘চল মা! একটা জায়গায় যেতে হবে’। আর আমি এক দৌড়ে ফ্রক পড়ে হাতের তালুতে সরিষা তেল নিয়ে সারা মুখে মাখিয়ে তৈরি হয়ে নিতাম।
কত বন-জঙ্গল, মেঠোপথ, নদীপথ পাড়ি দিয়েছি তোমার সঙ্গে তার হিসাব নাই। কখনো তোমার কাঁধে চড়ে, কখনো হাত ধরে, কখনো বাইসাইকেলটার পেছনে বসে তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। বাঁশের সাঁকোটা পাড়ি দেয়ার সময় ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে তোমার গলা জড়িয়ে রেখেছি শক্ত করে।
তুমি দূরে কোথাও সফরে গেলে পথ চেয়ে বসে থাকতাম, দিন গুনতাম তুমি কবে আসবে! আর বড় আপুদেরকে ভয় দেখাতাম, আমায় বকলে তোমাকে নালিশ করে দেবার! এটা বলে দেবো, ওটা বলে দেবো, বলে বলে সারা বাড়ির রাজত্ব করতাম। তুমি ফিরে এসে ক্লান্তি নিয়েই আমাকে কোলে বসিয়ে সব নালিশ শুনতে, তুমি বড় বোনদেরকে শাসিয়ে দিলে আমি বিজয়ীর হাসি নিয়ে খেলতে যেতাম।
আমি এখনো ভেজা পাটের গন্ধে থমকে যাই! চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নেই, দু’-একজনকে বলেছিলাম, ভেজা পাটের গন্ধ আমার ভীষণ ভালোলাগে, ওরা হেসেছিলো খুব। শুধু আমি জানি, ভেজা পাটের গন্ধে মিশে আছে তোমার ঘ্রাণ! সারাদিন পাট ধুয়ে তুমি ফ্যাকাসে হয়ে ঘরে ফিরতে, আমি তোমার শরীরের সেই গন্ধটা এই ভেজা পাটের গন্ধে খুঁজে পাই বাবা।
বাবা! আরও একবার হারাতে ইচ্ছে করে তোমার গলা জড়ানো সেই দিনগুলোতে। আরও একবার নালিশ করতে ইচ্ছে করে আমার একজীবনের সব দুঃখ যাতনার। একবার তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে বাবা, কষ্টগুলো তোমাকে বলা হয় না বহুদিন, বলা হয় না তুমি শাসন করে দিও, তুমি বলে দিও বাবা! আমি তোমার কলিজা ছিলাম।