মাকে ছাড়া দুই যুগ
এই জগৎ সংসারে মায়ের বিকল্প আর এমন কী আছে যদি এরকম একটি অনুসন্ধান করার ব্যবস্থা করা হয়, তবে যুগের পর যুগ অতিবাহিত হবে কিন্তু এর আসল ফলাফল পাওয়া যাবে না। শব্দের প্রতিশব্দ খুঁজলে সহজে পাওয়া যাবে, মায়ের প্রতিশব্দ শান্তির কোল এই পৃথিবীতে আরেকটি পাওয়া সম্ভব নয়। মা এমন একজন মানুষ যাকে ছাড়া একেবারেই চলা সম্ভব নয়। জীবনের শুরু থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মাকে পাশে থাকা চাই। সেই মা যদি কোনোক্রমে পাশে না থাকে তখন কেমন লাগবে এমন অনুভূতির ভাষা পৃথিবীতে এখনও জন্মও হয়নি। মাকে ছাড়া দুই যুগের বেশি কেটে গেল দেশ-দেশান্তরে। শুধু তাই নয়। মহাখুশির দিন, মহানন্দের দিন পবিত্র ঈদসহ প্রতিটি সময় কাটে মাকে ছাড়া।
জীবন থেকে প্রায় দুইযুগ অতিবাহিত হলো আমার জন্মধাত্রীর সান্নিধ্যহীন। যার গর্ভে নয়টি মাস থেকে অন্ধকার হতে আলোর জগৎ দেখতে পেয়েছি সেই মাকে ছাড়া জীবন আমার চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। প্রতিটি আনন্দক্ষণে ভেসে ওঠে আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি। বিষণ্ণতায় আমার মন বোবা কান্না করে নিভৃতে। কিন্তু প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস জন্মালে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাইতো আমাকে ছেড়ে মা না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আর কখনো আসবেন না, বলবেন না খোকা আছিস কেমন?
বিজ্ঞাপন
মাকে হারাবার বয়সটা খুব বেশি ছিল না। সবেমাত্র শৈশব পেরিয়ে কিশোর বয়সে পা রেখেছি। অনেককিছুই মনে নেই বয়সের কারণে। সম্ভবত ষষ্ঠ বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। একটি রোগেই মাকে চলে যেতে হলো দুনিয়া ছেড়ে। দীর্ঘদিন মা লিভার সিরোসিস রোগে ভুগে অবশেষে আমাকে এতিম করে নির্জন দেশে একাকী চলে গেছে। মৃত্যুর আগে ওই সময়কার নাম করা লিভার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মাহমুদ হাসানের কাছে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। যদিও সেই অনেক কিছুই বুঝিনা তবে এতটুকু এখনও কানে ভাসে, পৃথিবীর কোনো চিকিৎসা আর তোমার মাকে বাঁচাতে পারবে না। এটাই ডাক্তারের শেষ কথা।
মা থাকবে না এরকম কোনো অনুভূতি তেমন কাজ করেনি মনে। দীর্ঘ সময় পরে অনুভূতি জাগল মনে যে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধন হারিয়েছি। শুধু মা দিবস নয়, প্রতিটি ক্ষণে মায়ের কথা মনে পড়ে আর বুক ফেটে যায় নীরব কান্নায়। ভাবি কিছু দুঃখ যেন দুঃখই থেকে যায়। যা কাউকে স্পর্শ করে না। শুধু স্মৃতির পরতে পরতে দুঃখগুলো ভাসমান থাকে। এ পৃথিবীতে মায়ের স্নেহ-মমতা ছাড়া বেড়ে ওঠা বড় কষ্টের। যেখানে মায়ের আদর নেই সেখানে হাহাকার ছাড়া আর কী থাকতে পারে? যন্ত্রণার এক সাগর অতিক্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাই তো কিছু আনন্দের মুহূর্ত আমাকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। যেন এই সুখ আমার জন্য নয়। আমার কিশোরকালে মায়ের অকালমৃত্যু ঘটে। লিভার সিরোসিস নামক মারাত্মক ব্যধি আমার প্রিয় মাকে না ফেরার দেশে নিয়ে যায়। আমাকে একা করে, মায়ের বন্ধন ছিন্ন করে। মায়ের অপূর্ণতা যেন আমাকে প্রতিনিয়ত শাস্তি দেয়। জননীর ভালোবাসা ত্রিভুবনে আর কারো কাছে মিলবে না। কারণ মায়ের ভালোবাসা কারো কাছ থেকে পেতে স্বার্থের বলি হতে হয়। তাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একমাত্র মা ব্যতীত এই দুনিয়ায় পাওয়া যাবে না। স্বার্থের শেষ চূড়ায় থাকে গভীর ভালোবাসা। কিন্তু মায়ের বেলায় থাকে সীমাহীন নিঃস্বার্থ। জন্মের পর বেশ কয়েক বছর মাকে ডাকতে পেরেছি কিন্তু সে ডাকে মায়ের প্রতি যতটুকু ভালোবাসা থাকা দরকার সেটা হয়নি শুধু বয়স কম থাকার কারণে। আর যখন বয়স বাড়লো, বুঝতে শিখলাম ঠিক তখন মৃত্যুদূত এসে হাজির হল আমার প্রিয় মায়ের কাছে। মাকে আর তৃপ্তিভরে ডাকার সুযোগ দিলো না।
ভাগ্য মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তরের দেয়াল এঁটে দিল। যা ভেদ করে সেই ভালোবাসাকে পাওয়া সম্ভব নয়। স্বার্থহীন শুভাকাঙ্ক্ষী অন্ধকার জগৎ থেকে আলোতে এনেছেন সেই প্রিয় মাকে স্রষ্টা কেন দূরে নিয়ে গেলেন? যেখানে আমার মন এক সেকেন্ডের জন্য প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে না সৃষ্টির মালিকের অনুমতি ছাড়া। বন্দী না হয়েও জনম জনম বন্দী সেখানে দেখার কোনো সুযোগ নেই মাকে।
এ জীবনের জন্য এটি অপরিসীম অপূর্ণতা। মাকে নিয়ে লিখেই যাবো সমাপ্তির পথ খুঁজে পাওয়া এত সহজ নয়। পরবাসে এমনিতেই নানারকম চিন্তায় একা সময় কাটাতে হয়। বিষণ্ণতার ছোঁয়া প্রতিটি মুহূর্তে হৃদয়ে আঘাত হানে নীরবে। কাউকে বোঝাবার মতো ভাষা নেই। কী এক যন্ত্রণা মনে, যা হৃৎপিণ্ডকে স্পর্শ করে। তবু নীরবে সহ্য করতে হয়। সৃষ্টিকর্তা, পরম করুণাময় নিশ্চয়ই এতেই কল্যাণ লিখে রেখেছেন।
একটি সংসার স্বাবলম্বী হয় মাতা-পিতার সমন্বয়ে। কিন্তু এর মধ্যে একজন যদি অন্যত্র চলে যান তবে সেই সংসার অর্ধমেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ে। সময়ের পথচলা যত বেশি দৃঢ় হয় ততই সংসারে নানা তিক্ততা বাড়তে থাকে। আর ঝরে পড়া মানুষটি যদি হয় প্রিয় মা, তবে ওই সংসার সম্পূর্ণ মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ে। সময় যত যায় বৈরী বাতাসের প্রভাব বৃদ্ধি হতে থাকে। ছিন্নমূল করে দেয় পরিবারের সুখ। এমনিতেই প্রবাসে থাকা কষ্টকর, তারপরে আবার মা-বিহীন!
লেখক ও সংবাদকর্মী।