ডা. আয়েশা আক্তার, কাজ করছেন শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক হিসেবে। হাসপাতালের পরিচয়ে তিনি যতটা পরিচিত, তারচেয়ে বেশি ‘ডা. আয়েশা আপা’ নামেই জনপ্রিয় এ চিকিৎসক। করোনাকালীন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।

কর্মক্ষেত্রে মানবিক চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত এ চিকিৎসক শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, কাজ শেষে যখন বাসায় ফেরেন তখন আবার হয়ে উঠেন ‘সেরা মা’। একজন নারী হয়ে পাহাড় সমান বাধা পেরিয়ে সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করেও পরিবার থেকে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্ছিন্ন করেননি। বিশ্ব মা দিবসে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন জনপ্রিয় এ চিকিৎসক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : বিশ্ব মা দিবস আজ, একজন মা হিসেবে দিবসটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

ডা. আয়েশা আক্তার : বিশ্ব মা দিবসে সকল মায়েদের প্রতি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। কারণ একজন মা একদিকে যেমন সংসার চালাচ্ছেন, অন্যদিকে একজন কর্মজীবী মাকে তার কর্মক্ষেত্রও সমানতালে সামাল দিতে হচ্ছে। কর্মজীবী মাকে তার কর্মক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। তিনি কিন্তু অন্যসব গৃহিণীর মতো বাসায় থাকছেন না। দিনের একটা বড় সময় তাকে বাইরে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। এমনকি তার সে কাজটাকে প্রাধান্য দিয়েই দায়িত্ব সহকারে সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এরপর বাসায় এসে বাচ্চাকে টেককেয়ার করা এবং রান্নাবান্না করা থেকে শুরু করে দেখা গেছে সংসারের অধিকাংশ কাজই তাকে করতে হয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীরা অনেক বেশি স্বাবলম্বী। কর্মক্ষেত্রে তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ফ্যাসিলিটিগুলো পাওয়া যাচ্ছে, যা কিছু দিন আগেও সম্ভব হতো না। নারীদের সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে বাইরে চলাফেরা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নারীর অংশগ্রহণে সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে। এমনকি কর্মক্ষেত্রও অনেক বেশি ফ্রেন্ডলি হয়েছে, যে কারণে তারা কাজেও এগিয়ে যেতে পারছেন।

ঢাকা পোস্ট : দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাওয়ার সারথি হিসেবে নারীরা কতোটুকু ভূমিকা রাখছেন?

ডা. আয়েশা আক্তার : একজন মাকে সংসারও সামলাতে হয়, সন্তানকে দেখতে হয়,  রান্নাবান্নার কাজও করতে হয়। এতকিছুর মধ্যেও যখন একজন মা কর্মক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন বুঝতে হবে যে নারীরা আসলেই পুরুষদের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। তারাও পুরুষের মতো চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পারেন। দিনদিন যত বেশি নারী সামনের দিকে এগিয়ে আসবে, পুরুষের পাশাপাশি একসঙ্গে কাজ করবে, তত বেশি একটা দেশ উন্নতির দিকে যাবে।

আমরা এখন উন্নত বিশ্বের কাতারে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এসব কিছু মিলিয়ে আমাদের নারীদের নিয়ে ভাবা উচিত। একজন নারীর জন্য একইসঙ্গে সংসার, সন্তান এবং কর্মক্ষেত্র ম্যানেজ করা খুবই কঠিন। একদিকে অফিস সামলানো, বাসায় এসে সন্তানকে খাওয়ানো রান্নাবান্না করেও কিন্তু নারীকে সবসময় হাসিমুখে থাকতে হয়। দেশের নারীরা হাসিমুখেই এসব কাজ সমানতালে সামলে নিচ্ছেন।

ঢাকা পোস্ট : নারীদের পাশাপাশি সংসারের জন্য পুরুষের কোনো করণীয় আছে কি?

ডা. আয়েশা আক্তার: একজন পুরুষও বাইরে কর্মস্থলে কাজ করছেন। কিন্তু বাসায় গিয়ে নারীদের মতো সংসারের বাকি কাজ তাকে দেখতে হচ্ছে না। রান্নাবান্না, সন্তান সামলানোর কাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নারীর ওপর চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি একজন বাবাকেও কিছু ভূমিকা রাখা উচিত। আমরা অনেক পুরুষকেই দেখি কাজের ফাঁকে সংসারে নারীদের তারা সহযোগিতা করেন। এক্ষেত্রে মায়ের জন্য কাজগুলো সহজ হয়ে যায়।

ঢাকা পোস্ট : নিজে কীভাবে সংসার-সন্তান সামলে কর্মক্ষেত্রে সফল হয়েছেন?

ডা. আয়েশা আক্তার : আমাদের সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন একটা ছুটি আছে, যা আগে চার মাস ছিল বর্তমানে সেটি ছয় মাস করা হয়েছে। এতে করে জন্মের সময় বাচ্চার সঙ্গে বেশি করে সময় কাটানো যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস পর যখন এ ছোট বাচ্চাটিকে রেখে একজন মাকে কর্মক্ষেত্রে চলে যেতে হচ্ছে, সেটি মায়ের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের। 

যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক, আমার কাজই দেশের সেবা করা, সেক্ষেত্রে আমার কাছে এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সন্তানকে কর্মক্ষেত্রে মিস করলেও নিজের মনকে মানিয়ে নিয়েছি। আরেকটি বিষয় হলো, ছোট বাচ্চাটিকে বাসায় রেখে বাইরে গিয়ে কাজ করা, আবার বাসায় এসে তার দেখাশোনা করা, কাজগুলো যে কতটা কঠিন মা হওয়ার ফলে আমি নিজে তা দেখেছি। তবে একটা ভালো লাগার দিক হলো, আমি বাইরে যতই চাপ নিয়ে কাজ করি বা কষ্ট করি, বাসায় ফিরে যখন সন্তানের মুখটা দেখেছি তখন সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে।

ঢাকা পোস্ট : মানবিক ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আপনার অনুভূতি কী?

ডা. আয়েশা আক্তার : আমি আমার কর্তব্যটাই সবসময় যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করি। তবে মানবিক চিকিৎসক নামে আমাকে যারা ডাকেন, তাদের বেশিরভাগই গণমাধ্যমকর্মী। তারাও আমাদের মতো সম্মুখসারির যোদ্ধা। তারা সমাজের দর্পণ। তাদের লেখনী ও তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমেই দেশের মানুষ সব খবর জানে। তাদের সুরক্ষাও জরুরি বিষয়। তাই করোনাকালীন সময়ে অন্যান্য রোগীর পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদেরও আমি সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, এখনো করছি। ভবিষ্যতেও করব। মানবসেবায় নিজেকে যখন নিয়োজিত করেছি তখন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। মানুষজনের ভালোবেসে দেওয়া নাম এ কাজে অনুপ্রেরণা যোগায়।

ঢাকা পোস্ট : কর্মজীবী মায়েদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? 

ডা. আয়েশা আক্তার : কর্মজীবী মায়েদের জন্য বলব, দুটো কাজই আপনাকে সমানতালে চালিয়ে যেতে হবে, এ ক্ষেত্রে দুটি কাজেই আপনার ভালোলাগা কাজ করতে হবে। কারণ, কর্মক্ষেত্রের কাজও আমার কাজ, সংসারের কাজ আমারই কাজ। দুটি জিনিসকে একসঙ্গে করে নিলে মনেই হয় না যে কষ্ট হচ্ছে।

আমার কাছে যখন কোনো রোগী আসেন, তখন চিকিৎসা দেওয়ার পর তার মুখের হাসিটা যখন দেখি, এটাও তো আমার কাছে অনেক ভালো লাগার কারণ। যদি তাকে সেবা দেওয়ার কাজটি আমার জন্য কষ্টের। কিন্তু আমি যখন এটিকে মানব সেবা হিসেবে নিয়েছি, তখন আর আমার কাছে এটাকে কষ্ট মনে হয় না। অর্থাৎ আপনি যখন দুটি কাজকেই নিজের কাজ হিসেবে ভেবে সহজভাবে নেবেন, তখনই সে কাজটি আপনার ভালো লাগবে এবং এতোটা কষ্টের মনে হবে না।   

ঢাকা পোস্ট : দেশের কর্মক্ষেত্রগুলো কতটুকু মা বান্ধব?

ডা. আয়েশা আক্তার : উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কর্মজীবী মায়ের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তবে আগের তুলনায় এখন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। দেশের কয়েকটা হাসপাতালে ইতিমধ্যেই ডে-কেয়ার সেন্টার চালু হয়েছে, আরও কিছু হাসপাতালে কার্যক্রম চলছে। রাতারাতি তো আর এ অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে না। আমরা যেভাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, এরপর যেভাবে আমরা উন্নত দেশের তালিকায় পরিণত হব, তখন এই পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে যাবে।

বাসায় যখন আপনার শিশুকে দেখার কেউ থাকবে না, তখন ডে-কেয়ারগুলোতে বাচ্চারা ভালো থাকছে। এতে মা-ও নিশ্চিন্তে তার কাজগুলো করতে পারেন, সেইসঙ্গে বাচ্চাও সুরক্ষিত থাকে। আমি মনে করি দ্রুত বাকি হাসপাতালগুলোতেও ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করা উচিত।

এক নজরে ডা. আয়েশা আক্তার

জন্ম বরিশালে হলেও বেড়ে ওঠা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ছোটবেলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলে। পরে রাজধানীতেই শেষ করেছেন পড়ালেখা। কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় বরং বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকেই পড়ালেখা করে মানবসেবায় নিজেকে ব্রতী করে পরিচিতি পেয়েছেন মানবিক ডাক্তার হিসেবে। 

২২তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) এর মাধ্যমে সহকারী সার্জন হিসেবে চিকিৎসা পেশায় যোগদান করেন। ছিলেন সরকারি স্বাস্থ্য কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেছেন।  

টিআই/এসকেডি