ছবি: প্রতীকী

কয়েক বছর আগেও ‘মা দিবসে’ মাকে নিয়ে ফেসবুকে মজার মজার স্ট্যাটাস দিয়েছি। কখনো ভাবিনি এতো দ্রুত, এই বয়সে মাকে নিয়ে এমন কোনো স্মৃতিকথা লিখতে হবে। আমার আম্মু ছিলেন দায়িত্বশীল, শুধু দায়িত্ব পালনেই সব শেষ হতো না তার। কাজের ফাঁকে মজার ছলে সবাইকে মাতিয়ে রাখাও যেন ছিলো আম্মুর অন্যতম দায়িত্ব। হঠাৎ আমাদের এমন এমন কথা বলতেন, আমাদের সামনে এমন কিছু করতেন- আমরা সবাই হেসে খুন হয় যেতাম।

কিন্তু হঠাৎ আমাদের সব হাসি-খুশি ম্লান হয়ে গেল। আম্মুর শরীরে একইসঙ্গে একাধিক রোগ দানা বাঁধলো। দ্রুত ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়লো পেটে। সার্জারির রিস্ক নিতে পারছিলেন না ডাক্তাররা, কারণ আম্মু করোনা সাসপেক্টেড ছিলেন। করোনা টেস্টে নেগেটিভ দেখালেও এক্সরে রিপোর্টে পজেটিভ এসেছিলো।

সিরিয়াস পর্যায়ে চলে গেল সব। সব রোগের আলাদা আলাদা ডাক্তার। ডাক্তারেরা একজনের পর অন্যজন এসে শুধু মন শক্ত রেখে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলছিলেন। আম্মুকে আইসিইউতে দেওয়ার একদিন আগের কথা। সকালবেলা ডাক্তার ভিজিটে এসে বলে গেলেন- আম্মাকে কিছুক্ষণ পর পর ডানপাশ, বামপাশে ফিরিয়ে শোয়াতে।

ডাক্তারেরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে ডাকছি আর বলছি, ‘এই মানুষটাকে আমার জীবনে খুব দরকার। আম্মু আমার একমাত্র অবলম্বন, আমার বন্ধু, মানসিক শান্তি। তার কাছেই আমি মন খুলে কথা বলি। তাকে সব বলে আমি নিশ্চিন্তে, আনন্দে বাঁচি। এতো দ্রুত আমার মাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না। তোমার কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। আমার মাকে ফিরিয়ে দাও।’

ধীরে ধীরে আম্মুর শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিলো। কাউকে চিনতে পারছিলেন না। আমি কাছে গিয়ে বললাম, ও আম্মা! শুনছো? আমি ফারজানা। কিন্তু আম্মু কিছু বলে না। কখনো নিজের মাকে ডাকেন আবার কখনো আল্লাহকে ডাকেন। আমি আবার ডাকি, ও আম্মা! শুনছো? কতদিন তৃপ্তি নিয়ে খাই না। তুমি জানো না তোমার হাতের রান্না ছাড়া আমি তৃপ্তি করে খেতে পারি না?

তখন আম্মা একটু থামলেন। জড়ানো মিনমিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী?’

আমি আবার বললাম, একটু আমার দিকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরবা?

আমি আম্মার বেডের ডানপাশে বসা ছিলাম। আম্মা পাশ ফিরতে চাইলেন কিন্তু পারছিলেন না। আমি আরো কিছুটা এগিয়ে গেলাম। বললাম, আমার গলায় হাত দিয়ে আমার দিকে ফেরো। আম্মা আমার গলায় হাত দিয়ে ফিরলেন। আমি আম্মার মাথায় পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, ‘তোমাকে সুস্থ হয়ে ফিরতে হবে। আমার জন্য ফিরতে হবে। আমাদের জন্য ফিরতে হবে।’ কিন্তু আম্মু আর ফেরেননি। তিনদিন পর আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।

এটাই ছিলো আমাকে আম্মুর শেষ জড়িয়ে ধরা। এরপর আমি আম্মার প্রাণহীন দেহ জড়িয়ে ধরেছি, কপালে চুমু খেয়েছি, গালে- মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। আমার মায়ের শেষ স্পর্শ এতোটাই জীবন্ত; আমি এখন সেই অনুভূতি নিয়ে চলছি, ফিরছি এবং বেঁচে আছি। ২০২১ সালের ৬ আগস্ট বেলা ১২.০৬ মিনিটে আম্মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সবাই আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।