ছবি: প্রতীকী

যখন থেকে জানলাম চলে আসতে হবে ২৯৬৮ মাইল দূরে, তখন থেকেই আমার আবেগগুলো ক্রমশ সংকুচিত হতে শুরু করল, ঠিক আমার অগোচরেই। কী আশ্চর্য লাগে আজ সবকিছু। আমাকে বিদায় দিতে আম্মা পিছু পিছু অনেক দূর এলেন। মা-মেয়ের এমন নাড়িছেঁড়া বিচ্ছেদে আমরা কেউ কান্না করিনি, একটুকুও না!

মা-মেয়ে দুজনই হয়তো যুক্তি করে নিজেদের আবেগগুলো এত নিপুণভাবে আড়াল করেছিলাম। তবে হ্যাঁ, মা-মেয়ে দুজনই জানি আমরা কেউ কারও সামনে কাঁদিনি, কিন্তু কেউ জানি না কারও নির্ঘুম, নিঃসঙ্গ ও চোখের জলে বালিশ ভেজানোর একেকটি ভয়ংকর মুহূর্ত। বাবাও হয়তো জানেন না, তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে ঘুমের রাজ্যে রেখে সারা রাত না ঘুমিয়ে থাকা আমি তার বক্ষ মাঝেই মাথা রেখে কী পাঁয়তারা করছিলাম ঠিক আসার আগের রাতে, ৭ এপ্রিল ২০১৫।

আমার আম্মার আত্মত্যাগের কথা না বললেই নয়। যিনি ৮ সন্তানের গর্বিত এক মা। সন্তান লালন-পালন, সুশিক্ষা দিয়ে সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় এক দক্ষ ও পারদর্শী মা, সে আমাদের মা। সবাই যাকে জিজ্ঞেস করে কীভাবে এতগুলো ছেলে-মেয়েকে বড় করলেন, যেখানে অনেকেই দুই-চারজন ছেলেমেয়েকে বড় করতে হিমশিম খান। অনেক ত্যাগ স্বীকার করা ছাড়া তা কখনোই সম্ভব হতো না। প্রথমত আমার মা বেশ নিপুণভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। উনিতো আবেগ লুকানোর অভিনয় শুরু করেছেন সেই নব্বইয়ের দশকে। খুব সম্ভবত যখন আমার বড় বোনকে প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে পাঠান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেই থেকে এক এক করে ৮ ছেলেমেয়েকে দেশের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় এমনকি দেশের বাইরে পাঠাতে গিয়ে তিনি হয়ে গেলেন আবেগ লুকানোয় পারদর্শী।

যখন ভাইবোনদের বিদায় দিতেন তখন আম্মাকে আমি কখনোই কান্না করতে দেখিনি। হয়তো আড়ালে চোখের জলে শাড়ির আঁচল ভিজিয়েছেন। প্রতিটা মা এমনটাই করেন, যা আমরা কখনোই বুঝতে পারি না। কত সহস্র কষ্ট লুকিয়ে, কত বড় ত্যাগ করে সন্তানের মঙ্গলের জন্য সবকিছু মানিয়ে নেন আমাদের মায়েরা, তা যদি আমাদের সবার বোধগম্য হতো।

আজ জাপানে ৮ বছর কাটিয়ে দিলাম কী এক নেশায়। তবে দিন শেষে ওই সব নেশারা আর থাকে না আমার সঙ্গে। প্রতিরাতে বসে যাই স্বচ্ছ কাচের দেয়াল দেওয়া সেই মাধ্যমে যেখানে আয়োজন করে মায়ের স্নেহ ভালোবাসা, আদর আর খুনসুটি অনুভব করার এক আপ্রাণ প্রয়াস থাকে। সেখানেও চলে আবেগের লুকোচুরি। দুই পাশ থেকে কতসব সান্ত্বনামূলক বাক্য বিনিময়।

আম্মার ভাষ্যমতে, স্কাই্পের ভিডিও কলে দেখতে পারাটাই নাকি যথেষ্ট। তাই কোনো দরকার ছাড়া বছর বছর দেশে যাওয়াই মানা। এই মানা করার অন্তর্নিহিত অর্থটাও আমি বুঝি। বুঝতে না পেরে উপায় নেই যে। যত যাই বলি না কেন, সব মায়েরাই তার সন্তানকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে চান। পরম মমতায় নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখতে চান সেই ছোট্টবেলার মতোই। সন্তান কী আর বড় হয় মায়ের কাছে? হয় না, কিন্তু আমরা সন্তানেরাই মনে করি অনেক বড় হয়ে গেছি! দূরালাপনে যে ঠিক পোষায় না আমার সে কথা গলার নিচেই থেকে যায়, বের হয়ে আসতে চাইলে ঢোক গিলি বা ঘুমের অজুহাতে বিদায় নিয়ে নিই আগামী দিন কথা বলব বলে। সার্ভার ওঠানামা করার সঙ্গে সঙ্গে এই সব ভালোবাসা যে যান্ত্রিক হয়েই ধরা দেয় সেটার কোনো হিসাবই যেন করতে চাই না কেউ।

তারপরেও এতেই তৃপ্ত থাকার এক অনবদ্য অভিনয় করে যাওয়ার ৮ বছর পূর্ণ হলো। এই সব দূরবর্তী মাধ্যমে নিত্য কথা বললে কথারা একসময় ফুরিয়ে যায়। কিন্তু চাইলেই মায়ের বুকে মাথা রেখে ভাষাহীন কথাগুলো অনুভব করা যায় না। অতঃপর লাইনটা কেটে দিয়ে কখনো চোখের জলে বালিশ ভেজে আর কখনো আকাশপানে দৃষ্টি মেলে সবগুলো কষ্ট বাস্তবতায় ছুড়ে দিই। বাস্তবতা এমনই এক অস্ত্র যেখানে আমি বা আমাদের সবাই আত্মসমর্পণ করি। এভাবে করে করে সব আবেগ লুটিয়ে পড়ে মিশে যায় দীর্ঘ পথের পরিক্রমায়। নিজেকে নিজেই বুঝাতে থাকি যে এত আবেগ থাকতে নেই মানুষের, এত ভালোবাসা পেতে নেই কারও, বাঁচো তেমন করেই যেখানে যেমন।

আর এভাবে আমরা কঠিনেরে ভালোবাসতে শুরু করি। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়, বছর পেরিয়েও আরও বছর যায় আর আমরা একসময় নিজেদের অন্য মানুষ রূপে আবিষ্কার করি। শুধু যে আমরা নিজেরাই নিজেদের ওই রূপে আবিষ্কার করি তা নয়, এমনকি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই আমাদের বদলে যাওয়ার গান গায়। এই বদলে যাওয়া যতটা না অভ্যন্তরীণ তার চেয়ে বেশি যে বাহ্যিক সেটা বুঝতে অনেকেই ভুল করে, এমনকি আমরা যারা বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকি তারাও অভিনয় করতে করতে সেটাকেই একসময় বাস্তব মনে করতে থাকি। বাস্তবই তো, তা যদি নাই হতো তাহলে কেমন করে ৮ বছর পার করে দিলাম! দিন শেষে এই সব আত্মত্যাগই আমার শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস।

সবশেষে বলতে চাই, সবার দোয়ায় ভালো আছি আমি ও আমরা, ভালো থেকো আম্মা। খুব শিগগিরই তোমার সঙ্গে দেখা হোক আমার, হোক অবসান দীর্ঘ অপেক্ষার। 

পিএইচডি স্টুডেন্ট, জাপান অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইশিকাওয়া, জাপান।