ছবি: প্রতীকী

পৃথিবীর সবচেয়ে দুখী মানুষ আমার মা। মা শুধু কান্না করে, ভালো কিছু খায় না, কোথাও ঘুরতে যায় না। আমিও মাকে সবচেয়ে ভয়ংকর আর খারাপলাগার রূপে দেখে ফেলেছি এই জীবনে। যা সন্তান হিসেবে আমার সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতি। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু বাবার দেহ দাহ করে যখন ভোরে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানিকতা শেষে বাড়ি ফিরি তখন সবচেয়ে কষ্টের মুহুর্ত ছিল মাকে সাদা কাপড়ে দেখা। নানা রঙ-বেরঙের শাড়ি পরতে দেখে অভ্যস্ত মাকে হঠাৎ সাদা শাড়িতে দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয় লাগানো দৃশ্য এটি।

সেদিন থেকে মা আমার আর হাসে না, ভালো কাপড় পরে না, কোথাও ঘুরতে যায় না। দিনে কয়েকবার কান্না করে। সামান্য কিছুতেই ভয় পায়, একটু দূরে গেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মা ঘুমাতে পারেনা। একটা আতংক আর মানসিক ট্রমা নিয়ে মা বেঁচে আছে। এই ট্রমা শুরু গত বছরের এপ্রিলে। আমি ড্রাইভ করছি হঠাৎ মায়ের কল এবং কান্নাভেজা কন্ঠ ‌‘বাবা তারাতাড়ি আয় আমরা এক্সিডেন্ট করেছি’। বাবা-মার এক্সিডেন্ট শোনার পর আমি জা নিনা কীভাবে, কত গতিতে ড্রাইভ করে, কতক্ষণ পর স্পটে পৌঁছেছি!
 
তবে যে অজানা আতংক নিয়ে গেছি তা কেটে যায়। মা একটু আঘাত পেয়েছে এবং বাবার সম্ভবত হাড় ভেঙেছে। সাথে ছিল বন্ধু ফাহাদ। তাকে ড্রাইভিং সিটে দিয়ে বাবাকে নিয়ে পাশের হাসপাতাল যাই। এক্সেরেতে ধরা পরে বাবার হিপ জয়েন্ট ভেঙে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সে করে সিলেট নিয়ে যাই। ডাক্তার জানান মেজর কিছু না, অপারেশন করলেই ঠিক হয়ে যাবে এবং ১৫/২০ দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। সেই রাতেই বাবার প্রেসার বাড়তে শুরু করে। একটা পর্যায়ে তা হার্ট ফেইল হয় এবং ভোর বেলা আইসিইউতে নেওয়া হয়। সুস্থ বাবা মুহুর্তেই নিথর হয়ে পরে রইলেন আইসিইউতে। বাবা আমার কথা বলে না, মা হাসপাতালের কেবিনে ঈশ্বরকে ডাকছেন আর কান্না করছেন। বাবাকে নিয়ে ২৫ দিন ছিলাম আইসিইউ-সিসিইউতে। এখানে রেখেই অপারেশন হলো। আইসিইউতে বাবার জ্ঞান ফেরার পর যতবার খাবার নিয়ে যেতাম বাবার প্রথম প্রশ্ন থাকতো, ‘তোমার মা কিছু খেয়েছে? ওকে খাওয়াও। বেচারি টেনশন করে করে অসুস্থ হয়ে যাবে’। মনে মনে হাসতাম তাদের এই ভালোবাসা দেখে। বাবা যতদিন আইসিইউতে ছিলেন মা শুধু একবার দেখতে গিয়েছিলো আর যায়নি। বুঝেছিলাম বাবার এই কঠিন মুহূর্ত মা সহ্য করতে পারছেন না।

বাবার অপারেশন হলো। আমরা হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এলাম। অপারেশন পরবর্তী সেবা শুরু হলো। মা সারারাত জেগে থাকে। বাবা দাঁড়াতে পারেন না তাই মল-মূত্র জায়গায় বসেই ত্যাগ করতে হয়। মা সব সামলেছেন। বাবা তখন একেবারে শিশুর মতো। বাবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে, মাঝেমধ্যে মাকে ধমকও দেন। মা রাগ করে আবার একটু পরে ভুলেও যায়। বলে, অসুস্থ হয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে।

দিনে দিনে বাবার সেবা করে সুস্থ করে তুললো। এর মধ্যে আরো দুইবার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হলো আরও কয়েকবার। সেদিন ছিল ২৪ আগষ্ট। আমাদের পরিবারের জন্য শোকের দিন। আমার মায়ের জন্য সর্বনাশের দিন। ভোরবেলা বাবার প্রেসার বাড়ে, বাবা বার বার বলছিলেন আমি আর বাঁচবো না। এর কিছু পরেই বাবা জ্ঞান হারান। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে স্ট্রোক করেন। সারাদিন বাবা আইসিইউতে। মা সহ আমরা আইসিই- এর বাইরে। সবাই কান্না করছে, মার চোখ ফুলে গেছে মুহূর্তেই। রাত ৯টা ৩৪ মিনিট ডাক্তার জানালেন বাবা আর নেই। এরপরের কিছু মুহুর্ত লিখে প্রকাশ করা যাবে না। বাবাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। রাতে দাহ হলো।

পরদিন সকালে মাকে সাদা শাড়ি পরালো স্বজনরা। এরপর থেকে আমার মা আর মন খুলে হাসে না, শহরে আনতে চাইলেও মা আসে না। বাবার স্মৃতিজড়িত গ্রামের বাড়ি মা ছাড়বে না। আত্মীয়-স্বজনরা তাদের বাড়িতে নেওয়ার জন্য কত চেষ্টা করেছেন, মা কোথাও যায় না। ভালো শাড়ি পরে না। একবেলা খায় তো একবেলা খায় না। 

অসুস্থ হলেও চেপে রাখে, চিকিৎসা করাতে চায় না, আমাদের বলে না। কথায় কথায় কান্না করে। দিনের বেশিরভাগ সময় চোখ ভেজা থাকে। যেদিনে তাকায় শুধু থাকিয়েই থাকে। সবকিছুতে বাবাকে খোঁজে। বাবার প্রিয় খাবার বা সবজি ঘরে নিয়ে এলে মা শুন্যতা অনুভব করে। দুনিয়ার সবচেয়ে নিঃস্ব আর দুখী মানুষটি এখন আমার মা। বাবাকে ছাড়া আমার মা ভালো নেই।