সময় কত দ্রুত চয়ে যায়। ৫ বছর হয়ে গেছে মা না থাকার, তার কণ্ঠ না শোনার, তাকে নয়ন ভরে এক নজর দেখতে না পাওয়ার। ইট-কাঠের খাঁচায় আটকে থাকা ব্যস্ততায় আম্মাকে তেমন একটা মনেই পড়ে না আর, কিন্তু বন্ধু- কলিগদের ফোনে যখন তাদের মা ফোন দেয়, তখন তাদের ‘হ্যালো মা’ শুনলে বুকটা হু হু করে। আমার ফোনে তো আমার মায়ের কল আসে না। আসবেও না, কারণ আমার ‘মা’ যে চিরকালীন নেটওয়ার্ক এর বাইরে। 

সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক বাজারে যখন লিস্ট অনুযায়ী এক এক করে সব বাজার শেষ করে পান-সুপারির দোকান পার হই তখন বুকটা আবার হু হু করে উঠে। এমন কোনোদিন তো যায়নি যেদিন আম্মার জন্য বাজার থেকে পান-সুপারি ছাড়া বাড়ি গিয়েছি!

আম্মা মারা যাওয়ার পর তার ব্যবহৃত জিনিসপাতির মধ্যে ভাগে-যোগে আম্মার পানের বাটা’টা আমি নিয়ে নেই কারণ ওই পানের বাটা’টায় আম্মার স্পষ্ঠ গন্ধ লেগে আছে। একবিন্দু মিথ্যে নয়- এখনো মাঝে মাঝে ওই পানের বাটা নাকের কাছে ধরলেই সেই স্পষ্ট গন্ধ আমি পাই। কে বলে আমার মা নেই, আমি তো এই গন্ধেই বুঝতে পারি- আমার মা চুপটি করে এখনো এখানে লুকিয়ে আছে।

কত বছর আম্মার হাতের পিঠা খাই না! চুলায় পোড়ানো ভাপা পিঠা, কলাপাতায় মোড়ানো বিন্নি চাল আর নারিকেল দিয়ে বানানো ‘আথিক্কা পিঠা’। আহ! শীতকাল আসে আর যায়- আমার মায়ের হাতের বানানো পিঠা আর খাওয়া হয় না।

প্রতিবার বাড়ি গেলে বুঝি যে আম্মাবিহীন ঘর, আম্মাবিহীন শহর কতটা সুনসান, বিধ্বস্ত। স্বার্থ জড়ানো মমতায় ঢাকা আদিখ্যেতার বিপরীতে নিখাদ ভালোবাসার শুন্যতা আমাকে পোড়ায়- জ্বালায়। নিজের ভেতরটা অজান্তে চিৎকার করে বলে- আম্মাবিহীন এই ঘর, গ্রাম-শহর কিছুই আমার আপন নয়।

যে মানুষ আমার পুরো অস্তিত্বজুড়ে, সে মানুষকে আলাদা করে কী করে মনে পড়বে? আগে আমার মাকে ধরতে পারতাম, ছুঁতে পারতাম, অসুখের সময় কপালে হাত রাখতে পারতাম, মন খারাপ হলে তার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারতাম, আর এখন আমার মা থাকে আমার হাহাকারজুড়ে, আমার কান্নায়- অসুখের যন্ত্রণায়।

জানি না আম্মার সঙ্গে আবার কবে সাক্ষাৎ হবে, তবে আমি ঠিক করেছি আমার শেষ শয্যার স্থান যেন আমার মা আর আব্বার কবরের মাঝামাঝি হয়। ঠিক যেমনটি করে ছোটবেলায় দুইজনের মাঝখানে শুয়ে থাকতাম!

আম্মা তুমি ভালো থেকো, যেখানে আছো সেখানে অনেক ভালো থেকো।