২০১৫ সালের দিকে বাংলাদেশে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা আলোচনা হতো না। সেই সময়ে আমার মা ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন একবার। আমি ও আমার ছোট ভাই ডিপ্রেশনের সঙ্গে যুদ্ধ করে মাকে ফিরিয়ে আনি স্বাভাবিক জীবনে। এখন তিনি খুব হাসিখুশি, উদ্যমী ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ। 

তখন আমরা বুঝেছিলাম কেন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা উচিত। কীভাবে এর থেকে বের হওয়া যায়। একই সঙ্গে যারা কেয়ারগিভার থাকেন, তাদেরও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা উচিত। তাদেরও সাপোর্ট লাগে। একজন বিশ্বস্ত বন্ধু, ‍যিনি গোপনীয়তা রক্ষা করে জাজ মেন্টাল না হয়ে আপনাকে শুনবেন। সেই ভাবনা থেকে মনের বন্ধু শুরু করি ২০১৬ সালে।

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা খুব একটা কথা বলতে চাই না। আমাদের নানা রকমের কুসংস্কার, জড়তা ও দ্বিধা আছে। আমার মনে হয়েছে, সেই সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে একজন মানুষকে নতুন জীবনের দিকে নিয়ে যাওয়াই আসল চ্যালেঞ্জ। মনের স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বললে অনেকেই মনে করেন, হয়তো ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দুর্বল। আসলে সেটি সত্য নয়। মনের বন্ধু যখন আমরা শুরু করলাম, সেটি আসলেই একটা অনেক বড় পদক্ষেপ ছিল আমার জন্য। 

আমি তখন বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে প্রায় ১৩ বছর ধরে কাজ করছি। ফলে সেই কমফোর্ট থেকে বের হয়ে একটা অতিমাত্রায় চ্যালেঞ্জিং কাজকে পেশা হিসেবে নেওয়া আমাকে নতুন চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যায়। হাসিমুখে আমি আসলে একটি চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছিলাম।

মনের বন্ধুর শুরুর দিকে আমরা অনেক সচেতনতামূলক কাজ করতাম। আমরা এখনো তাই করি। যত মানুষ সচেতন হবেন নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি, তত সে সুস্থ থাকতে পারবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে শরীরও ভালো থাকে না।

করোনার সময়ে আমরা দেখেছি, মন ভালো থাকা কতটা জরুরি। কিন্তু পাঁচ বছর আগে মানুষকে সচেতন করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কেউ কেউ মুখ টিপে হেসেছেও। অনেকটা ব্যঙ্গ করে। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো অত গুরুত্ব দিত না।

মনের বন্ধু করতে গিয়ে আমাদের অনেক আর্থিক সংকট হয়েছে। চাকরি করে সেই জমানো টাকা দিয়ে মনের বন্ধুর কাজ করতাম। আমার মতো সমমনা যারা মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ হওয়া উচিত বলে মনে করতেন, তারা এগিয়ে এসে আমার পাশে, মনের বন্ধুর পাশে দাঁড়ালেন। এটা কিন্তু সত্য, আমি আমার পরিবার ও কয়েকজন কাছের বন্ধুদের থেকে অনেক সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি। আবার নারী হিসেবে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়েছে। সেগুলো কখনো আমার বাধা হতে পারেনি। আমি সব সময়ই মনে করেছি, বাধা ও চ্যালেঞ্জ হলো ভালো বন্ধু। তারা নতুন সম্ভাবনা খুলে দেয়। যা আপনি আগে কখনো ভাবেননি।

মনের বন্ধু প্রথম অনুদান পায় আইসিটি ডিভিশনের স্টার্টআপ বাংলাদেশের আইডিয়ার প্রজেক্ট থেকে। সে সময় তারা একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। সেই প্রতিযোগিতা জিতে প্রথম ব্যাচের একটি স্টার্টআপ হিসেবে আমরা অনুদান পাই। সেটাই আমাদের প্রথম অনুদান। যা দিয়ে আমরা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা কর্মশালা পরিচালনা করি।

তারপর ধীরে ধীরে ব্র্যাক, ইউএসএআইডি, ইউএনডিপি, ইএমকে সেন্টার, পাম নেদারল্যান্ডস, বিজিএমইএ, উজ্জ্বলা, কালারসএফএম, নাগরিক টিভি, ইবিএল ব্যাংক, পিবিএল, ওয়ান ব্যাংক সঙ্গে পার্টনারশিপ হয়। আমাদের কাজও এগিয়ে যেতে থাকে।

মনের বন্ধু যেহেতু মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ সাল থেকেই আমাদের প্রশিক্ষিত অভিজ্ঞ মনোবিদরা, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সব ধরনের গোপনীয়তা বজায় রেখে সেবা দেন।  মনের বন্ধু একটি নারীবান্ধব প্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতিতে শুধু নয়, এর আগেও কন্যা শিশু, মেয়ে ও সব বয়সের নারীরা তাদের মনোসংকটে মনের বন্ধুর থেকে সেবা নিয়েছে।

আমরা দেখেছি, মেয়ে শিশু ও কিশোরীর বাড়িতে ও কাছের মানুষরে দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে যান। তখন আমাদের সঙ্গে টেলিফোনে ও ফেসবুকে যোগাযোগ করেন। মনের বন্ধু থেকে ট্রমা থেরাপি নিয়েছেন অনেক মেয়ে ও নারী। ইউএনডিপির সহায়তায় ৫২টি জেলা থেকে ১৮০০০ মানুষ মনের বন্ধু  ২৪ ঘণ্টা ফ্রি ভিডিও ও টেলি কাউন্সেলিং সেবা নিয়েছে। আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি, ৬২.৯ শতাংশ নারী, যারা কোনো না কোনোভাবে শারীরিক বা মানসিকভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। 

কাছের মানুষের দ্বারা বা সাইবার বুলিং হয়েও অনেকে ট্রমাক্রান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। তাদেরকে মনের বন্ধুর বিশেষ প্রশিক্ষিত ট্রমা থেরাপিস্টরা কাউন্সেলিং সেবা দিয়েছে। ৯৯৯ নম্বরের কথাও আমরা রেফারেল হিসেবে বলি। মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সব সময় মনের বন্ধুতে গুরুত্ব পায়। অনলাইনে বিভিন্ন সুরক্ষা প্রশিক্ষণ, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, মনোবল ধরে রাখা কর্মশালা করানো হয় তাদের। কোনো কষ্টের মধ্য দিয়ে গেলে ট্রানজিশনাল অ্যানালাইসিসও শেখানো হয় নারীদের। 

মেয়েদের জন্য মেডিটেশন, ইয়োগা ও আর্টথেরাপি কর্মশালা আছে। যখন কেউ কোনো ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়, এগুলো তাকে সাহায্য করে সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। মনের বন্ধু ১৫০০০ গার্মেন্টস শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে বিজিএমইএর মাধ্যমে। এসএনভি নেদারল্যান্ডস, ডিবিসিসিআই ও নর্দান তসরিফা গ্রুপের সহায়তায় বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় প্রথম মেন্টাল হেলথ ওয়েলবিং সেন্টার তৈরি করেছে। নারী পোশাক শ্রমিকেরা ও পুরুষ পোশাক শ্রমিকেরা সহায়তা নিচ্ছে সেখান থেকে, সেলফ গ্রুমিং করছে। এছাড়া প্রথমবারের মতো বাংলায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ওপরে ৪০ ঘন্টার ফ্রি সার্টিফিকেশন কোর্স তৈরি করেছে মনের বন্ধু।
 
মনের বন্ধু কল ফর নেশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইয়ুথ কো. ল্যাব সিটি ফাউন্ডেশন জাতীয় পর্যায়ে সেরা স্টার্টআপ হয়েছিল। এসব অর্জন আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, যেমন অনুপ্রেরণা দেন আমার মেন্টররা। আমরা আমাদের ছোট ছোট অর্জনকেও খুব উদযাপন করি। যখন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সেশন করতে যাই, টিমমেটরা মিলে অনেক আনন্দ করি। আমাদের সেবা নেওয়ার পর ভালো সাড়া পেলে, কেউ প্রশংসা করলে, ভালো বললে মন ভরে যায় আনন্দে। তখন আর কোনো বাধাকে বাধা মনে হয় না, মনে হয় আরও নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। 

নতুন চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত আমি। নিজে মানসিকভাবে দৃঢ় হওয়া তাই খুব জরুরি। বিশেষ করে নারীদের। তাহলে কোনো কিছু তাকে সফল হওয়া থেকে আটকাতে পারবে না। হার না মানার মানসিকতা মনে গেঁথে ফেলতে হবে। মনের বন্ধুর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চাই আমরা।  

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, মনের বন্ধু