দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দুর্নীতিকে ক্যান্সার উল্লেখ করে বলেছেন, বিচার বিভাগে দুর্নীতিকে কখনো প্রশ্রয় দেবো না। দুর্নীতির বিষয়ে নো কম্প্রোমাইজ।
তিনি বলেন, আঙুলে ক্যান্সার হলে যেমন কেটে ফেলতে হয়, দুর্নীতিও তেমনি। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেওয়া হবে ঘোষণা দেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২ ডিসেম্বর) অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সংবর্ধনার সময় প্রধান বিচারপতি এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি মামলার জট কমানো, বিচার বিভাগ থেকে দুর্নীতি দূর করা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সমন্বয়ে কাজ করার কথা ব্যক্ত করেন।
নবনিযুক্ত বাংলাদেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে সংবর্ধনা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির ১নং বিচার কক্ষে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল লিখিত বক্তব্য পাঠ করে সংবর্ধনা দেন।
লিখিত বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নতুন মাত্রায় উন্নীত করার মাধ্যমে আমার প্রতি আপনাদের দেখানো এই সম্মান সমুন্নত রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের সকল বিজ্ঞ আইনজীবী, সকল স্তরের বিজ্ঞ বিচারক, সকল বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাষ্ট্রের অপর দুইটি বিভাগের সক্রিয় সহযোগিতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া আমার উপর অর্পিত এই পবিত্র দায়িত্ব সফলভাবে পালন করা কঠিন হবে। বার ও বেঞ্চ হলো একটি পাখির দুইটি ডানা আর জুডিশিয়ারি হলো সমস্ত দেহ। পাখা দুটি সমানভাবে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি। বারের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই কোর্ট পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সর্বস্তরে মামলার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, আদালত অনুপাতে বিচারকার্যে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি, আদালতসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, বিচার বিভাগে ডিজিটালাইজেশন, আধুনিক বিচার প্রশাসন কৌশল প্রণয়ন, উন্নত প্রশিক্ষণ, বিচার কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের যোগান, রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতার নিরিখে বিচারকদের প্রয়োজনীয় দাবি পূরণসহ আরও যেসব বিষয় রয়েছে সে সম্পর্কে আমি সজাগ ও সচেতন রয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেটদের স্টেনোগ্রাফার দেওয়া হয়েছে। সহকারী জজদেরও স্টেনোগ্রাফার দেওয়া গেল মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বাড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, ন্যায়বিচারে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বিজ্ঞ আইনজীবীগণের সমস্যা সম্পর্কেও আমি জ্ঞাত আছি। আমি বিশ্বাস করি,
বিচার বিভাগের এই সকল প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা আগের চেয়ে বেশি গতিতে চলবে। বিচার বিভাগের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা যতদূর সম্ভব সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, যে জাতি তার ৩০ লক্ষ সন্তানের রক্তের বিনিময়ে এবং কোটি কোটি মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে, অসীম সাহসিকতার সাথে জীবন বাজি রেখে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে পারে, সে জাতি বিচার বিভাগের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না- এটা আমার কখনই বিশ্বাস হয় না। আমি বরাবর আশাবাদী একজন মানুষ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, “ব্যর্থ না হওয়ার সব চাইতে নিশ্চিন্ত পথ হলো সাফল্য অর্জনে দৃঢ় সংকল্প হওয়া।” বিচার বিভাগের সমস্যা সমাধানের জন্য নেতৃত্বের দায়িত্ব আমাদের সকলকে যৌথভাবে পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করলে অবশ্যই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারব ইনশাহ আল্লাহ। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি অঙ্গ যদি দুর্বল বা সমস্যাগ্রস্ত হয় তাহলে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে পারে না। সে কারণে আমি বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের অপর দুটি বিভাগ তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিচার বিভাগের সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রাষ্ট্রের সকল বিভাগ ও ব্যক্তিকে অবশ্যই বারবার স্মরণ করতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে
গণতান্ত্রিক সভ্যতা পরাজিত হবে।
বিচার বিভাগের সন্ধিক্ষণে কর্মকৌশল নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র এক হাজার নয়শ জন বিচারকের কাঁধে যে বিপুল পরিমাণ মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে তা বিচার বিভাগের জন্য কোনোভাবেই
সুখকর নয়। আমার দায়িত্বভার গ্রহণের সূচনালগ্নে সকল স্তরের বিজ্ঞ বিচারকদের আহ্বান জানাব, আসুন কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসা দিয়ে অধিক পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই। এটি হবে বিচার বিভাগের জন্য মামলার জট থেকে মুক্তির যুদ্ধ।
মামলাজট নিরসনে মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশের সকল অধস্তন আদালতে মামলা জট নিরসন তথা বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ৮টি বিভাগের জন্য একজন করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতিকে প্রধান করে একটি করে মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। প্রতিমাসে আমি তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতিবেদন গ্রহণ করব। পুরাতন মামলাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নিষ্পত্তির বিষয়ে সুপারভাইস এবং মনিটরিং করা হবে। সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক সময় ও দক্ষতার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রত্যেক বিচারককে মামলা নিষ্পত্তির অভূতপূর্ব অভিযাত্রায় অগ্রসেনানী হওয়ার এক ইতিবাচক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
ন্যায় বিচার জনগণের সহজাত অধিকার মন্তব্য করে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ন্যায়বিচার জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া জনগণের প্রতি দয়া নয় বরং এটি জনগণের সহজাত অধিকার। আমি এই অধিকারকে কেবল সাংবিধানিক অধিকার বলে সাব্যস্ত করতে রাজি নই। ন্যায়বিচারের সৌকর্য এবং আইনের রাজকীয়তা প্রকৃতপক্ষে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। সে কারণে দেশের সকল বিজ্ঞ বিচারককে নিরপেক্ষতার সাথে, নির্মোহ হয়ে, নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এই প্রসঙ্গে আমি মহান গ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআনের সূরা নিসা’র ১৩৫ নং আয়াতকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই-
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে অটল থেকো। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সত্য সাক্ষ্য দেবে। সত্য বলার কারণে যদি তোমার নিজের ক্ষতি হয় অথবা মা-বাবা বা আত্মীয়ের ক্ষতি হয়, তবুও সত্য সাক্ষ্য দেবে। আর পক্ষদ্বয় বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন (সে বিবেচনা না করেই) সত্য সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহ প্রাধিকার ওদের সবার ওপরে; লোভ-লালসা বা প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে ন্যায়বিচার
থেকে দূরে সরে যেও না। যদি পক্ষপাতিত্ব করে পেঁচানো কথা বলো, সত্যকে বিকৃত করো বা পাশ কাটিয়ে যাও তবে মনে রেখো, আল্লাহ সব কিছুরই খবর রাখেন।’
বিচার বিভাগে কোনো দুষ্ট ক্ষতকে ন্যূনতম প্রশ্রয় দেবো না উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সকল শাখাসমূহের অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, অলসতা এবং অযোগ্যতাকে নির্মূল করতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে আমি সকলকে পাশে পাবো- এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যারা নিয়ামক শক্তি রয়েছেন তারা সকলে আমাদের প্রতি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন- এটা আমার একান্ত আবেদন। ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয় এমন সকল কারণ চিহ্নিত করে তা দূর করার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর হবো। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার কোনো অশুভ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হোক- তা কখনই মেনে নেওয়া হবে না।
যেকোনো গঠনমূলক আলোচনা ও সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়ে কবি গুরুর ভাষায় প্রধান বিচারপতি বলেন, “নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়।” আপনারা যারা বিচার বিভাগের আলোচক ও সমালোচক বন্ধু রয়েছেন তারা বিচার বিভাগের সমস্যা উপলব্ধি করবেন, নিঃসংকোচে আলোচনা বা সমালোচনা করবেন- রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর কল্যাণকামীতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে। স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মর্যাদা নিয়ে বাংলাদেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আঠারো কোটি মানুষের ন্যায়বিচারের ভরসা¯হলো বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের পবিত্র রক্তের অক্ষরে লেখা সুমহান সংবিধানের চেতনা সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দায়িত্ব পালন করবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সব সময় সংবিধানে বর্ণিত “সাম্য ও ন্যায়ানুগ” সমাজ গঠনে দৃশ্যমান, কার্যকরী ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখবে মর্মে আমি প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বক্তব্যে প্রকাশ করার চেয়ে কর্মক্ষেত্রে বাস্তবায়নে ব্রতী হওয়াকে আমি অধিকতর জরুরি মনে করি। এক্ষেত্রে আমরা সকলেই হাতে হাত রেখে একত্রিত হয়ে কাজ করব- এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা দয়া করে জুনিয়র আইনজীবীদের প্রতি একটু সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাবেন। তাঁদের কষ্ট আমি অনুভব করি, যেহেতু আমি নিজে অনেক কষ্ট করেছি। জুনিয়র আইনজীবীদের অনুরোধ করব শক্তি হবে শিক্ষা, জ্ঞান ও দীক্ষার। সম্মান অর্জন করতে গেলে সম্মান দিতে জানতে হবে। আমি আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করব, আপনারা সবার প্রতি আপনাদের শপথের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ ও ব্যবহার করবেন।
এমএইচডি/ওএফ/এইচকে