রাজধানীর মিরপুরের ডিওএইচএসের বাসিন্দা খোন্দকার গাউছ মহিউদ্দিন ও মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা ফারিয়া আলম। দুই জনই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। ২০১০ সালে তাদের বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে এই দম্পতির সংসারে পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। সুখেই সংসার চলছিল।

গত জুন মাস থেকে সুখের সংসারে নেমে আসে অশান্তি। পারিবারিক অশান্তি থেকে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মধ্যে জুলাই মাসের প্রথম দিকে একদিন শেষ রাতে কাউকে না জানিয়ে ফারিয়া আলম শিশু সন্তান নিয়ে স্বামীর বাসা থেকে চলে যান। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দেন তিনি। সন্তানকে কেও তার বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।

পরে সেপ্টেম্বর মাসে আইনজীবীর দ্বারস্থ হন শিশুর বাবা খোন্দকার গাউছ মহিউদ্দিন। আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ দেন তিনি। পরে সন্তানসহ তার স্ত্রী আইনজীবীর চেম্বারে আসেন। ফারিয়া আলম লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেন সন্তানকে বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেবেন, দেখা করতেও দেবেন। কয়েকদিন যেতে না যেতেই  হঠাৎ স্ত্রী জানান সন্তানকে বাবার কাছে পাঠাবেন না, দেখতেও দেবেন না। এ কথা জানানোর একদিন পরই তালাক নোটিশ পাঠান স্বামীকে। একইসঙ্গে পারিবারিক আদালতে শিশুর অভিভাবকত্ব নিয়ে একটি মামলা করেন শিশুর মা। উপায় না পেয়ে গত ১৮ নভেম্বর চার বছরের সন্তানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে বাবা হাইকোর্টে রিট করেন। শিশুর বাবার পক্ষে রিট আবেদনটি দায়ের করেন ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ।

রিটের শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২২ নভেম্বর রুল জারি করেন এবং সন্তানসহ মাকে ৬ ডিসেম্বর হাজির করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন।

গত ৬ ডিসেম্বর পল্লবী থানা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দিয়ে হাইকোর্টকে জানানো হয়, ফারিয়া আলম সন্তানসহ টার্কিশ এয়ারওয়েজে ১৮ নভেম্বর কানাডায় চলে গেছেন। হাইকোর্টে রিট দায়েরের পরই তিনি চলে গেছেন। ওই দিন শিশুর বাবা সন্তানকে কানাডা থেকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের প্রতি নির্দেশনা চেয়ে আরেকটি আবেদন করেছেন

গত ৬ ডিসেম্বর পল্লবী থানা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দিয়ে হাইকোর্টকে জানানো হয়, ফারিয়া আলম সন্তানসহ টার্কিশ এয়ারওয়েজে ১৮ নভেম্বর কানাডায় চলে গেছেন। হাইকোর্টে রিট দায়েরের পরই তিনি চলে গেছেন। ওই দিন শিশুর বাবা সন্তানকে কানাডা থেকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের প্রতি নির্দেশনা চেয়ে আরেকটি আবেদন করেছেন।

আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ জানান, হাইকোর্ট রিট মামলাটি স্ট্যান্ডওভার রেখেছেন। আদালত বলেছেন, যেহেতু ফ্যামিলি কোর্টে মামলা করা আছে, সেখানে গিয়ে এ বিষয়গুলো জানান। ফ্যামিলি কোর্ট থেকে অর্ডার নেন। ফ্যামিলি কোর্টে মামলা চলাকালে চলে গেছে। ফ্যামিলি কোর্টে মামলা হওয়ার সাথে সাথে কিন্তু বাচ্চা আদালতের জুরিসডিকশনে চলে আসে। কোর্ট থেকে অর্ডার না নিয়ে বাচ্চা নিয়ে যেতে পারেন না। মামলা থাকাকালীন যে চলে গেছে, সে বিষয়টি আমরা বলব।

এ বিষয়ে নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারিবারিক আদালতে মামলা চলাকালে সন্তানকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া জঘন্যতম অপরাধ। এটি দেশের আইনের লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

একই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশি নাগরিক শাহিনুর টি আই এম নবী ও ভারতীয় নাগরিক সাদিকা সাঈদের সন্তান নিয়ে। স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের জেরে হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে তিন বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে শাহিনুর টি আই এম নবী পালিয়ে গেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেছেন সন্তানকে। আদালতের আদেশ অমান্য করে অস্ট্রেলিয়ায় শিশুকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি বাবা শাহিনুর টিআইএম নবীকে ছয় মাসের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আদালতের এ আদেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকার ও অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।

এ মামলার নথি থেকে জানা যায়, ভারতের বিয়ে সংক্রান্ত ওয়েবসাইট থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদের সাদিকা সাঈদ শেখ নামে এক মেয়েকে বিয়ের জন্য পছন্দ করেন ঢাকার বারিধারার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান শাহিনুর টি আই এম নবী। মেয়েটি হায়দ্রাবাদের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান।

২০১৭ সালে হায়দ্রাবাদে তাদের ঘটা করে বিয়ে হয়। বিয়ের পর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাস শুরু করেন তারা। কয়েক মাস পর ঢাকায় চলে আসেন। এর মধ্যে এ দম্পতির ঘরে ২০১৮ সালে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। একপর্যায়ে তাদের সংসারে অশান্তি নেমে আসে। সাদিকা শেখকে মারধরও করেন স্বামী শাহিনুর। তার সঙ্গে ভারতের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। বিষয়টি ভারতে মেয়েটির আত্মীয়-স্বজনরা জানতে পারেন। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হয়। তারপরও সমাধান হয়নি। পরে হাইকোর্টে রিট করা হয়। সন্তানের জিম্মা নিয়ে সম্প্রতি এ ধরনের অনেক মামলা হাইকোর্টে আসছে। বাবা-মায়ের জেদ বা বিরোধের বলি হচ্ছে সন্তানরা।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পারিবারিক বিরোধে প্রকৃত ভিকটিম হচ্ছে সন্তান। বাবা-মায়ের বিরোধের খেসারত দিতে হচ্ছে সন্তানদের। দেখা যাচ্ছে, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে অশান্তি সৃষ্টি হয়, তখন তারা শুধু নিজেদের কথা চিন্তা করেন। সন্তানের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন না। উভয়েই সন্তানের সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করলে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। ডিভোর্স হতেই পারে, তবে সেটা যেন শিশুর ক্ষতির কারণ না হয়। বাবা কিংবা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত যেন না হয়, সে বিষয়টিও দেখতে হবে।

এমএইচডি/এসএসএইচ