নারায়ণগঞ্জের সাত খুন
চূড়ান্ত আপিল শুনানিতে আর কত অপেক্ষা
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামান। র্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে এবং তার গাড়িচালককেও র্যাব তুলে নিয়ে যায়। ওই রাতেই সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিল ছয়জন এবং পরদিন একজনের মরদেহ ভেসে ওঠে
সাড়ে সাত বছর পেরিয়ে গেছে। দেশ কাঁপানো নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। মামলাটি আপিল বিভাগে ঝুলে থাকায় আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করা যাচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলার প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন। সেই আপিল এখনও বিচারাধীন। হাইকোর্টের রায়ের পর চার বছর অতিবাহিত হলেও চূড়ান্ত আপিল শুনানি এখনও শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাত খুনের মামলাসহ চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুত শুনানি শুরু হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপিল বিভাগেও যেন হাইকোর্টের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা সেই চেষ্টা করব। চূড়ান্ত আপিল শুনানির জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী এফ আর এম লুৎফর রহমান আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা তো অনেক বড় মামলা। আপিল শুনানির অংশ হিসেবে আমরা মামলার সারসংক্ষেপ (Concise Stetment) লেখা শুরু করেছি। আমরা সেখানে ফাঁসির দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করার যুক্তিগুলো তুলে ধরব। আশা করছি ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে মামলার সারসংক্ষেপ সর্বোচ্চ আদালতে দাখিল করতে পারব। তারপর আপিল শুনানি শুরু করার জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করব।
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট
হাইকোর্টের রায়ে যা আছে
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া নিম্ন আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নয়জনের দণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।
উচ্চ আদালত বলেন, ‘আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে’
যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিরা হলেন- সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন।
হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলেন
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, র্যাব একটি এলিট ফোর্স। মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য এরা বহুবিধ কাজ করেছে। কতিপয় ব্যক্তির জন্য সামগ্রিকভাবে এ বাহিনীকে দায়ী করা যায় না। তাদের ভাবমূর্তি নষ্টেরও কারণ নেই। কতিপয় অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। উচ্চ আদালত বলেন, ‘আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।’
বিচারিক আদালতের রায়
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি মরদেহ। পরদিন মেলে আরেকটি মরদেহ। নিহত অন্য ব্যক্তিরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।
ঘটনার একদিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা (পরে বহিষ্কৃত) নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় ১১ মে একই থানায় আরেকটি মামলা হয়। এ মামলার বাদী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। পরে দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত দুই মামলার রায় দেন। রায়ে র্যাবের সাবেক ১৬ কর্মকর্তা-সদস্য এবং নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার অপরাধজগতের নয় সহযোগীসহ মোট ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া র্যাবের আরও নয় সাবেক কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর সাজা পাওয়া আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুতের জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখাকে নির্দেশ দেন।
কী ঘটেছিল সেদিন
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামান। র্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে এবং তার গাড়িচালককেও র্যাব তুলে নিয়ে যায়। ওই রাতেই সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিল ছয়জন এবং পরদিন একজনের মরদেহ ভেসে ওঠে।
এর এক সপ্তাহের মধ্যে ওই ঘটনায় র্যাব-১১ এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ পায়। টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। একসঙ্গে সাতজনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ।
ওই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন কাউন্সিলর নজরুলের অনুসারীরা। গণমাধ্যম ও সারাদেশে বিষয়টি হয়ে ওঠে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু।
এমএইচডি/এমএআর