দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখছেন | ছবি- ঢাকা পোস্ট

আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) কেলেঙ্কারিতে ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

সোমবার (২৫ জানুয়ারি) দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এদিন দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়- ১ এ সংস্থাটির উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাগুলো দায়ের করেন।

মামলার বিষয়ে দুদক সচিব বলেন, ‘ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় মোট ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ৩৫০ কোটি টাকা ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন, পরবর্তীতে ওই অর্থ বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর-রূপান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপনপূর্বক পাচার করে অপরাধ করেছেন।’

ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় মোট ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ৩৫০ কোটি টাকা ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন, পরবর্তীতে ওই অর্থ বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর-রূপান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপনপূর্বক পাচার করে অপরাধ করেছেন

দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার

দুদক সচিব আরও বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস’র সাবেক চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, সাবেক এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) মো. রাশেদুল হক, নয়জন বোর্ড মেম্বার, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীসহ, পি কে হালদারের আত্মীয়-স্বজন ও সহযোগীসহ মোট ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।

পি কে হালদারের বান্ধবী অবন্তিকা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নামে ৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মেসার্স বর্নের নামে ৬৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, রাহমান কেমিক্যালস লিমিটেডের নামে ৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং মুন এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪০৯, ৪২০, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২), (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৪ জানুয়ারি) পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এমডি রাশেদুল হকের বিরুদ্ধে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করে দুদক। আজ (সোমবার) আবারও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ দুজনকে আদালতে পাঠানো হয়। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

এর আগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের করা ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের মামলায় তার ব্যক্তিগত আইনজীবী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা, সহযোগী অবন্তিকা বড়াল ও শঙ্খ ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।

আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নামে ৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মেসার্স বর্নের নামে ৬৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, রাহমান কেমিক্যালস লিমিটেডের নামে ৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং মুন এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়…

অন্যদিকে পি কে হালদারের সহযোগীদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে আইএলএফএসএল’র ৮৩ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬২ জনের হিসাবে এক হাজার ৫৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।

পি কে হালদারের সহযোগীকে নেওয়া হচ্ছে আদালতে | ছবি- ঢাকা পোস্ট 

ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের পরপরই পি কে হালদারের নাম উঠে আসে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর হাজির হতে নোটিশ দেয় দুদক। ৩ অক্টোবর পি কে হালদারের বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঠিকই দেশ থেকে পালিয়ে যান। পরে দেশে আসার কথা বলেও আসেননি। এরই মধ্যে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল।

ব্যর্থ কর্মকর্তাদের তালিকা চান হাইকোর্ট

সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া পি কে হালদার কাণ্ডে আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট ও অর্থপাচার উদঘাটনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থ কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে এ তালিকা দাখিল করতে বলা হয়েছে।

গত ২১ জানুয়ারি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালত বলেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি বিভাগের কর্মকর্তারা কেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট ও অর্থ পাচারের বিষয়টি উদঘাটনে ব্যর্থ হলো তা আমাদের জানতে হবে। দায়িত্বে থেকে কাজ করবে না, সেটার সুযোগ নেই।

হাইকোর্টে বিনিয়োগকারীদের আবেগঘন কান্না

পি কে হালদারের প্রতারণার শিকার সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়েসহ ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা আত্মসাৎ করা টাকা ফিরিয়ে দিতে আদালতের কাছে আকুতি জানান। উচ্চ আদালতকে তারা বলছেন, 'আর্থিক ও মানসিক কষ্টে আমরা মারা যাচ্ছি, আমাদের বাঁচান।'

গত ৩ জানুয়ারি দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান হাইকোর্টকে বলেন, পিপলস লিজিংয়ের কয়েকজন আমানতকারী কিছু বলতে চান। পরে অনুমতি নিয়ে হাইকোর্টে নিজেদের দুর্দশার কথা বলেন চার আমানতকারী।

প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) | ফাইল ছবি 

সামিয়া বিনতে মাহবুব নামের এক আমানতকারী অশ্রুসিক্ত নয়নে হাইকোর্টকে বলেন, 'মাই লর্ড, আজ আমি একজন ক্যান্সারের রোগী। আমার এখন আর চাকরি নেই। করোনা আসার পর থেকে আমার স্বামীরও চাকরি নেই। আমি আর আমার স্বামী মিলে আমাদের জীবনের কষ্টার্জিত টাকা পিপলস লিজিংয়ে আমানত রেখেছিলাম। এখন আমরা আমাদের টাকা পাচ্ছি না! এতটা অসহায় হয়ে গেছি যে, এবার বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি। গত ১ বছর বাচ্চাদের একটু মাছ-মাংস খাওয়াতে পারিনি। আমরা আর্থিক-মানসিক কষ্টে মারা যাচ্ছি। আমরা এখন কার কাছে যাব? মাই লর্ড, আপনাদের কাছে আকুল আবেদন আমাদের বাঁচান।'

একপর্যায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের মেয়ে ড. নাশিদ কামাল হাইকোর্টকে বলেন, 'মাই লর্ড, আমার বাবা এবং আমিসহ পরিবারের ৫ জন পিপলস লিজিংয়ে টাকা আমানত রেখেছি। আমরা সরল বিশ্বাসে আমাদের টাকাটা রেখেছিলাম। আমরা গণমাধ্যমে জেনেছি পি কে হালদার এখান থেকে টাকা নিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং। তাই এখানকার আমানতকারী হিসেবে আমরা আমাদের টাকাটা ফেরত চাই।'

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. শওকতউর রহমান হাইকোর্টকে বলেন, 'মাই লর্ড, দেশটা কি স্বাধীন করেছিলাম এভাবে নিজে প্রতারিত হওয়ার জন্য? আমি আমার আমানতের টাকাটা ফেরত চাই।'

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বিনিয়োগকারীদের এসব কথা শুনে রুলের শুনানিতে তাদের পক্ষভুক্ত করে নেন। একইসঙ্গে এফিডেভিট আকারে বিনিয়োগকারীদের এই বক্তব্য আদালতে দাখিল করতে বলা হয়।

আরএম/জেডএস/এমএআর/