সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিচার-ব্যবস্থায় ‘মেডিয়েশন’ বা ‘মধ্যস্থতা’ শব্দটি বহুল আলোচিত হচ্ছে। মামলাজট কমাতে মেডিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এর অংশ হিসেবে মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রতিপালন সুপ্রিম কোর্ট থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 

সারাদেশে বাছাই করা ২৮০ বিচারককে মেডিয়েশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় পর্যায়ক্রমে মেডিয়েশন সেন্টার স্থাপনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

মেডিয়েশন কী

প্রথমেই প্রশ্ন জাগতে পারে মেডিয়েশন কী। মেডিয়েশন বা মধ্যস্থতা হচ্ছে একটি পন্থা বা পদ্ধতি। এর মাধ্যমে বিরোধীয় পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যা বা বিরোধের সমাধান করা হয়। এ পদ্ধতিতে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন তাকে মেডিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারী বলা হয়।

মেডিয়েশন পদ্ধতিতে যিনি মেডিয়েটরের দায়িত্ব পালন করেন, তিনি বিরোধী পক্ষগুলোকে তাদের মধ্যকার সমস্যা সমাধানের জন্য একজন সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেন। মেডিয়েটর সাধারণত একজন নিরপেক্ষ ও  প্রশিক্ষিত ব্যক্তি হন। বাংলাদেশে দুই ধরনের মেডিয়েশন হয়ে থাকে। একটি হলো ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। অপরটি হলো কোর্ট অ্যানেক্স (আদালত সংযোজন) মেডিয়েশন। ব্যক্তি পর্যায়ের মেডিয়েশনে পক্ষগণ আদালতে না গিয়ে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একজন মেডিয়েটর বা মধ্যস্থতাকারীর সহযোগিতা নিয়ে সমস্যার সমাধান করেন।

 

অপরদিকে কোর্ট অ্যানেক্স মেডিয়েশন হলো কোনো পক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করলে আদালত সন্তুষ্টচিত্তে পক্ষগণকে মেডিয়েশনে বসার জন্য  প্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আদালত একজন মেডিয়েটরকে ওই মোকদ্দমার বিবাদমান বিষয় নিষ্পত্তির জন্য দায়িত্ব অর্পণ করেন।

মেডিয়েশন পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি হলে আদালত বাদীর কোর্ট ফি ফেরত দেন। মূলত চারটি পন্থায় বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করা যায়। যেমন- নেগোসিয়েশন (আলাপ-আলোচনা), কন্সিলিয়েশন (সমঝোতা), মেডিয়েশন (মধ্যস্থতা) ও আরবিট্রেশন (সালিশ)। এ চার পন্থার মধ্যে সবচেয়ে সহজ, জনপ্রিয় ও যুগোপযোগী হলো মেডিয়েশন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিয়েশন হচ্ছে একটি পথ যার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং মামলার জট কমাতে ভূমিকার রাখছে।

মেডিয়েশন হচ্ছে একটি পথ যার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং মামলার জট কমাতে ভূমিকার রাখছে

এ বিষয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তিতে মেডিয়েশন আগামী দিনের বিচার-ব্যবস্থায় সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিতে পরিণত হবে। কারণ, মেডিয়েশনের মাধ্যমে দ্রুত ও কম খরচে মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব।

‘অন্যদিকে, আরবিট্রেশন (প্রচলিত বিচার) মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর কেটে যায়। প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। তবুও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। তাই বিচারপ্রার্থীদের মেডিয়েশন পদ্ধতি সম্পর্কে বিচারকদের সচেতন করতে হবে। বিরোধ বা মামলা নিষ্পত্তিতে মেডিয়েশন বেস্ট সলিউশন (সবচেয়ে ভালো সমাধান)।’

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতে ৪০ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। মেডিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগই এ জটের নিরসন সম্ভব।

বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতে ৪০ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। মেডিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগই এ জটের নিরসন সম্ভব

গত ৫ আগস্ট বিচারপ্রার্থীদের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় এবং আদালতে মামলার জটের চাপ কমাতে মেডিয়েশন (মধ্যস্থতা) মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে নির্দেশিকা জারি হয়। সুপ্রিম কোর্টের জুডিশিয়াল রিফর্মস কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নির্দেশক্রমে আবশ্যিকভাবে মধ্যস্থতার সংশ্লিষ্ট বিধানাবলি পালনে এ নির্দেশিকা জারি হয়।

ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী এক বৈঠকে বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি জমা দেওয়া কোর্ট ফি পর্যন্ত ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৯ (এ) ও ৮৯ (সি) ধারা এবং অর্থঋণ আদালতের ২২ ধারাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনে থাকা মধ্যস্থতা সংক্রান্ত বিধি-বিধান পালনে নির্দেশিকা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ফলে পক্ষগণের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বিরোধ নিষ্পত্তির আইন অনুযায়ী বর্ণিত মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ এবং নির্ধারিত দিনের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে সময় বাড়ানো সুযোগ রয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে আবার মামলা করার জন্য পক্ষগণ আদালতে যেতে পারবেন।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর স্বাক্ষরিত সার্কুলারে ‘বিভিন্ন আইনে বর্ণিত মধ্যস্থতা সংক্রান্ত বিধানাবলি প্রতিপালনার্থে অনুসরণীয় নির্দেশিকা, ২০২১’- এ বলা হয়েছে, দেওয়ানি মোকদ্দমায় লিখিত জবাব দাখিলের পর আদালত শুনানি মুলতবি করে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং মধ্যস্থতা সংক্রান্ত শুনানির জন্য একটি তারিখ ধার্য করবেন।

মেডিয়েশন পদ্ধতি সম্পর্কে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে বিরোধ মীমাংসার জন্য মেডিয়েশন পদ্ধতি সর্বোত্তম। কারণ, এ পদ্ধতিতে বিরোধ মীমাংসা হলে উভয়পক্ষ বিজয়ী হন। কেউ পরাজিত হন না। উভয়পক্ষের মধ্যে ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ বিরাজ করে।

মেডিয়েশন পদ্ধতি বিচার ব্যবস্থায় ফলপ্রসূ করতে বিচারক ও আইনজীবীদের একযোগে কাজ করতে হবে— বলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ আইন কর্মকর্তা।

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মেডিয়েশন নিয়ে কাজ করছে ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মেডিয়েশন সোসাইটি (বিমস)’ নামের সংগঠন। বিমস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এস এন গোস্বামী বলেন, করোনাকালীন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে আমাদের সহযোগিতায় কয়েক ধাপে অধস্তন আদালতের বিচারকদের মেডিয়েশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে বাছাই করা মোট ২৮০ বিচারক এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আহমেদ সোহেলসহ আন্তর্জাতিক মেডিয়েশন বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

‘আমি মনে করি, আধুনিক বিশ্বের মতো বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থায়ও মামলার জট কমাতে একমাত্র পদ্ধতি মেডিয়েশন। এ পদ্ধতি মামলার জট কমাতে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো ভূমিকা রাখতে পারে। এ কারণে সরকারের নীতিনির্ধারকসহ সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন মেডিয়েশন পদ্ধতি প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। মেডিয়েশন প্রতিপালন বাধ্যতামূলক করে সুপ্রিম কোর্ট থেকে সার্কুলার জারি করা হয়েছে’— বলেন বিমস চেয়ারম্যান।

এমএইচডি/এমএআর/এমএইচএস