সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমান ও ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের নিবন্ধ মানহীন। এ ধরনের নিবন্ধ কীভাবে জার্নালে প্রকাশিত হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বলেছে, এডিটোরিয়াল বোর্ড ও রিভিউয়াররা তাদের দায় এড়াতে পারে না।

শিক্ষক সামিয়া রহমান ও মারজানের গবেষণা জালিয়াতির অভিযোগের ঘটনায় শাস্তি নির্ধারণের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনে বলা হয়, সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের যৌথভাবে লেখা ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ নামক প্রবন্ধটিতে ৬০টি অনুচ্ছেদের মধ্যে প্রায় ৪৮টি অনুচ্ছেদ কপি করা হয়েছে। তন্মধ্যে এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ বইয়ের বিভিন্ন অংশ (পৃষ্ঠা: ৮৭-৯১) থেকে প্রবন্ধটিতে ২৭ শতাংশ কপি করা হয়েছে। 

এছাড়াও, ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ প্রবন্ধ থেকেও আনুমানিক পাঁচ পৃষ্ঠা (৩০ শতাংশ) কপি করা হয়েছে। এমনকি, ফুকোকে নিয়ে রায়ান জ্যাকবসের লেখা থেকেও কোনো রেফারেন্স ছাড়াই নিজেদের লেখায় (৫ শতাংশ) কপি করা হয়েছে। টারনিটিন পদ্ধতির মাধ্যমে দেখা যায়, এই প্রবন্ধটিতে বিভিন্ন সোর্স থেকে আনিত প্রায় ৭০ শতাংশ টেক্সটের মিল আছে। 

লেখকদ্বয় এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর লেখাকে সরাসরি নিজেদের বলে দারি করেননি সত্য। তবে, সাইটেশনের নিয়মানুযায়ী, সরাসরি উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে শব্দসীমা থাকে, যা তারা অনুসরণ করেননি। যদিও লেখকদ্বয় তাদের লিখিত বক্তব্যে বলছেন, প্রবন্ধটি এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর তাত্ত্বিক কাজের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ। প্রবন্ধটির কোথাও এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর বক্তব্যকে নিজেদের বক্তব্য বলে দাবি করেননি। প্রবন্ধটির শেষের দিকে এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর রেফারেন্সও দেওয়া হয়েছে। আর্টিকেলটিতে সাইটেশনের ভুল আছে, তবে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং সাইটেশন ত্রুটি বলে বিবেচনা করা যায়। 

অভিযুক্ত আর্টিকেলটি ২০১৬ সালে সাবমিট করা হয়। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টারনিটিন সফটওয়্যারের সুবিধা ছিল না। যদি থাকত তাহলে এই অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো ধরা পড়ত। এমন একটি দুর্বল ও মানহীন প্রবন্ধ কীভাবে ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ জার্নালে ছাপা হলো তা ট্রাইব্যুনালের নিকট বোধগম্য নয়। রিভিউয়ার ও এডিটোরিয়াল বোর্ড অবশ্যই তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য তারা দায় এড়াতে পাবেন না। এ ধরনের ভুলের জন্য এডিটর ও এডিটোরিয়াল বোর্ডকে অভিযুক্ত করা উচিত ছিল বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করে। 

প্রবন্ধটি জমা দেওয়া থেকে শুরু করে রিভিউ, চূড়ান্তভাবে গ্রহণ ও ছাপানোর প্রক্রিয়াতে অস্বচ্ছতা ও অদক্ষতা রয়েছে বলে প্রত্যক্ষভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এডিটোরিয়াল বোর্ড তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। 

ট্রাইব্যুনাল মনে করে, লেখকদ্বয় যেমন প্রবন্ধটি লেখার জন্য দায়ী ঠিক সমভাবে রিভিউয়ার ও এডিটোরিয়াল বোর্ডের সদস্যরাও দায়ী। তদন্ত কমিটিকে প্রবন্ধটির রিভিউয়ার ও এডিটরিয়াল বোর্ডের সদস্যদেরকে সাক্ষাৎকারে না ডেকে শুধুমাত্র লেখকদ্বয়কে অভিযুক্ত করায় ন্যায়বিচার পরাহত হয়েছে বলে মনে করছে ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত কমিটি কেবল লেখকদ্বয়ের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের অভিযুক্ত করেছে। এডিটোরিয়াল বোর্ড ও রিভিউয়ারদের সাক্ষাৎকারে না ডেকে এবং অ্যালেক্স মার্টিনের অভিযোগের ভিত্তি অনুসন্ধান না করে প্রতিবেদন দেওয়ায় প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতা এবং ভিত্তি দুর্বল বলে ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।  

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল আরও দেখতে পায় যে, তদন্ত কমিটিকে শুধুমাত্র ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’ এর ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত অভিযুক্ত প্রবন্ধটি তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটি লেখকদ্বয়ের যৌথভাবে লিখিত আরও কিছু প্রবন্ধের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছে যা প্রয়োজন ছিল না।

ট্রাইব্যুনাল আরও দেখতে পায় যে, যদিও লেখকদ্বয় অভিযুক্ত প্রবন্ধটিতে প্রতি পাতায় ফুট নোট উল্লেখ করেনি, কিন্তু প্রতি প্যারায় উদ্ধৃতির পূর্বে এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর নাম উল্লেখ করেছেন। এছাড়া প্রবন্ধটির শেষেও রেফারেন্সে এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর রেফারেন্স দিয়েছেন। প্রবন্ধের কোথাও এডওয়ার্ড সাঈদ বা মিশেল ফুকোর কোনো উদ্ধৃতিকে লেখকদ্বয়ের নিজের উদ্ধৃতি বলে দাবি করেননি। তাই তাদের এ কার্যক্রমকে সরাসরি প্লেজারিজমের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না।

ট্রাইব্যুনাল দেখতে পায়, অভিযোগটি উত্থাপিত হয় ২০১৭ সালে, তদন্ত শেষ হয় ২০১৯ সালে এবং ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় অক্টোবর ২০২০ সালে। এত দীর্ঘ মেয়াদী তদন্তের ফলে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ পেয়েছে। একইভাবে অভিযুক্ত শিক্ষকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে, যা কখনো ন্যায়বিচারের জন্য কাম্য নয়। এত দীর্ঘসূত্রিতা মূলত ন্যায়বিচারকে পরাভূত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের সুপারিশ অংশে বলা হয়েছে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান ও ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান কর্তৃক যৌথভাবে লিখিত ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : এ কেস স্ট্যাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ নামক প্রবন্ধটির সঙ্গে এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ ও মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ লেখার মিল থাকায় তাদের অভিযুক্ত প্রবন্ধটি গবেষণা প্রবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না বিধায় তা ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’  থেকে বাতিল করার সুপারিশ করছে। 

এছাড়াও, মিল থাকায় ও অনভিপ্রেত ভুলের জন্য স্থগিত অভিযুক্ত শিক্ষকদ্বয়কে আগামী এক বছর পদোন্নতি থেকে বিরত রাখা এবং প্রত্যেকের একটি করে বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিতের সুপারিশ করছে। এ সুপারিশ উভয়ের ক্ষেত্রে একই সময় শুধু এক বছরের জন্য কার্যকর হবে। 

উল্লেখ্য, গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য জমা দেওয়ার পর রিভিউয়ারের মতামত গবেষকদের নিকট প্রেরিত হয়নি/সংশোধনের সুযোগ পায়নি (গবেষকদ্বয়ের স্বীকারোক্তি ও তদন্ত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি অনুযায়ী), রিভিউয়ার ও এডিটোরিয়াল বোর্ড দায়িত্ব পালনে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ উত্থাপন, তদন্ত থেকে ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তিন বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হয়েছে তাই হলো। অপরাধ মার্জনার দৃষ্টিতে বিবেচনা করে শান্তি লঘু করার সুপারিশ করা হবে। ভবিষ্যতে তাদের কোনো গবেষণায় এ ধরনের ভুল থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তাদেরকে সতর্ক করার সুপারিশ করছে। 

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের জার্নাল প্রকাশের ক্ষেত্রে অনুষদের ডিনের মাধ্যমে এডিটরিয়াল বোর্ড, রিভিউয়ার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে গবেষণা কর্ম সম্পন্ন এবং প্রকাশনার সব বিধি মেনে চলতে ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণের অনুরোধ করে পত্র দেওয়ার সুপারিশ করছে। ভবিষ্যতে প্রকাশিত কোনো প্রবন্ধ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, এডিটোরিয়াল বোর্ড ও রিভিউয়ারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে মর্মে সতর্কতা পত্র দেওয়ার সুপারিশ করছে।

ভবিষ্যতে ন্যায়বিচারের স্বার্থে যেকোনো অভিযোগ দায়েরের পর থেকে অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময় (সর্বোচ্চ তিন মাস) অনুসরণ করতে সুপারিশ করছে।

 এমএইচডি/ওএফ