চার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি : রায় কাল
এস কে সিনহার ‘যাবজ্জীবন’ চায় রাষ্ট্রপক্ষ
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। রাষ্ট্রের আইন-আদালতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে আইনকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাত্র দুদিনে হাতিয়ে নেন চার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে তিনি মানেননি কোনো নিয়মনীতি। অবৈধভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সমুদয় অর্থ হাতিয়ে নেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা)। অভিনব উপায়ে তাকে ঋণের এ অর্থ পাইয়ে দেন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। যারা ছিলেন এস কে সিনহার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন।
ওই ঘটনায় ২০১৯ সালের ১০ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে কমিশনের জেলা সমন্বিত কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
বিজ্ঞাপন
এ মামলায় অভিযোগপত্রে নাম থাকা এস কে সিনহা ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন— ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী, রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় (সিমি)। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ তদন্তকালে মারা যাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ নিয়ে একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করেন
আসামিদের মধ্যে পলাতক রয়েছেন- এস কে সিনহা, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৫ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
মামলার এজাহারে যা আছে
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ নিয়ে একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করেন। পরে ওই টাকা ব্যক্তিগত হিসাব থেকে অস্বাভাবিক নগদে এবং চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য হিসাবে হস্তান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। পাশাপাশি ওই টাকার উৎস ও অবস্থান গোপনের মাধ্যমে পাচার বা পাচারের চেষ্টায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, জনৈক মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি চলতি হিসাব খোলেন। এর পরদিনই তারা দুই কোটি করে চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। ব্যাংকে হিসাব খোলা এবং ঋণ আবেদনপত্রে দুজনই তাদের ঠিকানা বাড়ি নম্বর ৫১, সড়ক নম্বর ১২, সেক্টর ১০, উত্তরা আবাসিক এলাকা উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই বাড়িটি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ব্যক্তিগত বাড়ি। ঋণ আবেদনে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে রঞ্জিত চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের সাভারে অবস্থিত ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করেন। তারা দুজনও সাবেক প্রধান বিচারপতির পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠজন।
ঋণ অনুমোদন হওয়ার পরের দিনই আবেদনকারীদের আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে অনুমোদিত চার কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু করা হয়। পরে ওই পে-অর্ডার সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার হিসাবে জমা হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ ও চেক/পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলেন
এজাহার বলছে, ঋণসংক্রান্ত আবেদন দুটি কোনো রকম যাচাই-বাছাই, রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতি না মেনেই শুধু গ্রাহকের আবেদনের ওপর ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে হাতে হাতে ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই ছাড়াই অফিস নোট তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর দিয়ে সাবেক এমডি এ কে এম শামীমের কাছে নিয়ে যান। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ নীতি অনুযায়ী ঋণ দুটির প্রস্তাব অনুমোদন করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের না থাকা সত্ত্বেও তিনি এ সংক্রান্ত যাচাই-বাছাই বা নির্দেশনা না দিয়ে ওই ঋণ প্রস্তাব দুটির অনুমোদন দিয়ে দেন।
ঋণ অনুমোদন হওয়ার পরের দিনই আবেদনকারীদের আবেদনের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে অনুমোদিত চার কোটি টাকার পৃথক দুটি পে-অর্ডার সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে ইস্যু করা হয়। পরে ওই পে-অর্ডার সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার হিসাবে জমা হয়। তিনি বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক ক্যাশ ও চেক/পে-অর্ডারের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলেন।
ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য জন্য সান্ত্রী রায় ব্যবহার করেন নিরঞ্জন ও শাহজাহানকে। নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা শান্তি রায়ের স্বামী রঞ্জিতের ভাতিজা। আর শাহজাহান রঞ্জিতের বন্ধু। ফারমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় বন্ধক রাখা হয় সান্ত্রী রায়ের মালিকানায় থাকা সাভারের ৩২ শতাংশ জমি। আইনজীবীদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের মে মাসে জমির বায়না দলিল হয় এবং ওই বছরের ৮ নভেম্বর দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এস কে সিনহা সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার মাধ্যমে চার কোটি টাকা গ্রহণ করেন। ২৪ নভেম্বর হস্তান্তর দলিলের মাধ্যমে বাড়িটি সান্ত্রী রায় বুঝে নেন।
কী বলছে রাষ্ট্রপক্ষ
মামলার রায়ের বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে বলে আশা করছি।
সিনহাসহ পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে রায় ঘোষণা হোক। এরপর সিনহাসহ বাকিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
মামলার উল্লেখযোগ্য আসামি মাহবুবুল হক চিশতী। তার বিষয়ে আইনজীবী শাহিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী ছিলেন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশিটে চিশতীর বিষয়ে বলেন, বাবুল চিশতীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও প্রভাবে এ ঋণের অনুমোদন হয়। কিন্তু মামলার এজাহারে বলা হয়, এস কে সিনহার প্রভাবে এ ঋণ পাস হয়। আমরা আদালতে প্রমাণ করতে পেরেছি যে মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী এ মামলার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাব।’
টিএইচ/এমএআর/