কোনো পরিবার চায় না সন্তান জঙ্গিবাদে যাক : জাবেদের বাবা
২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত ভবনে পুলিশ চেক পোস্টে আত্মঘাতী বোমা হামলা মামলায় জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাবেক কমান্ডার জাবেদ ইকবালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার সময় আদালতে ছিলেন আসামি জাবেদের বাবা আব্দুল আউয়াল সিকদার।
রোববার (৩ অক্টোবর) আদালত থেকে বের হওয়ার পথে আব্দুল আউয়াল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সে তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত, সিরিয়াস অনুতপ্ত। আশা করেছিলাম এ মামলায় জাবেদের সাজা হবে না। আমি যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব। শাস্তি তো একটা হবে। আরও কম সাজা হবে বলে আশা করেছিলাম। সেটা হয়নি।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। কোনো পরিবার তার সন্তানকে জঙ্গিবাদে জড়াতে অনুমতি দেয় না। জাবেদ শুধু মিস গাইডেড হয়ে না, হাই মোটিভেটেড হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিল।
আব্দুল আউয়াল সিকদার বলেন, ১৯৯৬ সালে তালেবান সরকার গঠনের পর জাবেদ জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। জেএমবি গঠনের শুরুতেই জাবেদ তালেবানে জড়িয়ে যায়।
ছেলে অনেক মেধাবী ছিল দাবি করে তিনি বলেন, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ছাত্র ছিল। ১৯ বছর বয়সে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তখন জাবেদ ভালো খারাপ বুঝতে পারেনি। অন্যের কথায় মিস গাইড হয়েছে।
আবদুল আউয়াল বলেন, ১৯ বছর বয়সে গ্রেফতার হয়েছিল। এখন ৩৫ বছর বয়স। জাবেদ অনেক অনুতপ্ত। নিজে ক্যান্সারের রোগী জানিয়ে তিনি বলেন, আজ ছেলের সাজা হবে জানতাম। তবে সাজার পরিমাণ কম হবে বলে আশা করেছিলাম। জাবেদের বাবা আব্দুল আউয়ালের বাড়ি কক্সবাজার সদরে।
রোববার চট্টগ্রাম সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুল হালিমের আদালত ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত ভবনে পুলিশ চেক পোস্টে আত্মঘাতী বোমা হামলা মামলায় জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানের মৃত্যুদণ্ড ও জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাবেক কমান্ডার জাবেদ ইকবালের যাবজ্জীবন কারদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন।
জাবেদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিষয়ে চট্টগ্রাম সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মনোরঞ্জন দাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আদালত জাবেদ ইকবাল ওরফে মোহাম্মদের বয়স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিবেচনা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এছাড়া জাবেদ অনুতপ্ত। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এছাড়া তাকে দুই লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত।
তিনি আরও বলেন, রায় ঘোষণার সময় জাবেদ ইকবালের খুবই স্বাভাবিক ছিলেন। আদালত ৩২ জনের সাক্ষ্য ও সবকিছু বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন।
মনোরঞ্জন দাশ বলেন, জাবেদ ইকবালের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। কারণ সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। জাবেদ হামলার ঘটনার পরিকল্পনাকারী, নীল নকশাকারী। এছাড়া জাবেদ ইকবাল জেএমবির সদস্য বলে নিজেই স্বীকার করেছে। তার কাছ থেকে বোমা উদ্ধার করা হয়েছিল। সাক্ষীরা তার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিল।
রায় ঘোষণার সময় জাবেদকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়েছিল। আর জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান পলাতক রয়েছে।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। জাবেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করব। কারণ জাবেদ হামলার পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী।
তিনি বলেন, জাবেদ হামলার বিষয়ে নিজের সম্পৃক্তার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। অপরাধের কথা স্বীকার করেছে, অনুতপ্ত হয়েছে। যে ঘটনায় দুই জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে ও অনেক মানুষ আহত হয়েছে। সেই মামলায় জাবেদের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করেছিলাম। যিনি নিজেই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। তাই তার যাবজ্জীবন প্রত্যাশা করি না। তার মৃত্যুদণ্ড চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের পুলিশ চেক পোস্টের সামনে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে ঘটনাস্থলে মারা যান পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়া ও ফুটবলার শাহাবুদ্দীন। আহত হন পুলিশ কনস্টেবল আবু রায়হান, সামসুল কবির, রফিকুল ইসলাম, আবদুল মজিদসহ ১০ জন।
এ রায় ঘোষণা কেন্দ্র করে রোববার সকাল থেকে আদালত চত্বরে নেওয়া হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আদালত সূত্রে জানা যায়, বোমা হামলায় নিহতের ঘটনায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ২০০৬ সালের ১৮ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক হ্লা চিং প্রু জেএমবির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমান্ডার জাবেদ ইকবাল ও বোমা তৈরির কারিগর জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই মামলাটির অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে অন্য একটি মামলায় জেএমবির সাবেক প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই এবং জেএমবির সাবেক সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানির ফাঁসির আদেশ কার্যকর হওয়ায় তাদের মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে মামলাটি ওই ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। একই বছরের ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল মামলাটি গ্রহণ করেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২১ সেপ্টেম্বর রায়ের জন্য আজকের (৩ অক্টোবর) তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন আদালত।
কেএম/এসএসএইচ