এপাশে সাক্ষ্যগ্রহণ, ওপাশে ওসি প্রদীপের মোবাইলে কথোপকথন!
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। কীভাবে ভাইকে হত্যা করা হয়, সেই বর্ণনা আদালতে উপস্থাপন করছিলেন তিনি। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তখন ১৫ আসামি। তাদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ দেখা যায় আসামি প্রদীপ কুমার কাঠগড়ায় বসেই মোবাইল ফোনে কথা বলছেন! সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি এই প্রদীপ কুমার দাস।
গতকাল সোমবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এমন চিত্র চোখে পড়ে। যার স্থিরচিত্র ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
আদালত সূত্রে জানা যায়, আলোচিত সিনহা হত্যা মামলাটির বিচারকার্যক্রম গতকাল (সোমবার) থেকে শুরু হয়েছে। এদিন বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয় প্রদীপ কুমার দাসসহ ১৫ জনকে। দুপুর ১২টার দিকে প্রদীপের আইনজীবী মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন ফেরদৌসকে জেরা করছিলেন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রদীপ তখন হঠাৎ কয়েকজন আসামির আড়ালে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল দেয়ালের দিকে মুখ করে মাথা নিচু করে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন তিনি। এ সময় অন্য আসামিরা তাকে যেন আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন!
প্রদীপের দুই গজ দূরেই ছিলেন কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক সদস্য। তিনি প্রদীপকে ফোনে কথা বলতে বাধা দেননি। পাশে পুলিশ সদস্যদের জন্য দুটি চেয়ার বরাদ্দ থাকলেও সেখানে কাউকে বসে থাকতে দেখা যায়নি।
কে বা কারা তার হাতে মোবাইল ফোনটি দেন, এ বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। কাঠগড়ায় কীভাবে মোবাইল ফোন পেলেন প্রদীপ— জানতে চাইলে কক্সবাজার আদালত পুলিশের পরিদর্শক চন্দন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা আমার জানা নাই। এটা সঠিক না। এরকম কোনো সুযোগ নাই
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কাঠগড়ায় প্রদীপ খালি পায়ে ছিলেন। স্যান্ডেল বাইরে রেখে এসেছিলেন। কয়েক মিনিট কথা বলেন তিনি। এরপর ফোন রেখে দাঁড়িয়ে যান। ২টা ১০ মিনিটে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিলে সবাই স্বাভাবিকভাবে এজলাস থেকে বেরিয়ে আসেন। ঘণ্টাখানেক পর আবারও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। তবে তখন প্রদীপের হাতে মোবাইল ফোন দেখা যায়নি।
কে বা কারা তার হাতে মোবাইল ফোনটি দিলেন, এ বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। কাঠগড়ায় কীভাবে মোবাইল ফোন পেলেন প্রদীপ কুমার দাস— জানতে চাইলে কক্সবাজার আদালত পুলিশের পরিদর্শক চন্দন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা আমার জানা নাই। এটা সঠিক না। এরকম কোনো সুযোগ নাই।’
ঢাকা পোস্টের কাছে মোবাইল ফোনে প্রদীপের কথা বলার স্থিরচিত্র আছে— এমনটি জানালে তিনি আর কিছু বলেননি।
কাঠগড়ায় বিচারকের দিকে পেছন ফিরে বসে আসামির মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ আছে কি না— জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোর্টের (আদালত) একটা ম্যানার (আদব-কায়দা) রয়েছে। কোর্টে কেউ চাইলেই পেছন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। জজ সাহেব যখন দাঁড়াবেন তখন আপনি বসে থাকতে পারেন না। উনি যখন বসবেন তখনই বসতে পারেন।’
‘একজন বিচারক এবং আদালতকে এভাবেই যথাযথ সম্মান দিতে হয়। এছাড়া কোর্টের ভেতরে ফোনে কথা বলা, হইহুল্লোড়, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারির মতো কাজগুলো যদি করা হয়, এটা তো কোর্টকে অসম্মান করা বোঝায়! একইভাবে এগুলো কোর্টের কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটায়। এসব কাজ আদালত অবমাননার শামিল। এগুলো জজ সাহেব নিজে দেখেই আমলে নিতে পারেন। অথবা কেউ জজ সাহেবের আমলে আনতে পারেন। সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে তিনি (জজ সাহেব) আসামিকে শোকজ করবেন। প্রয়োজনে তাকে তাৎক্ষণিক সাজাও দিতে পারেন।’
‘অনেক সময় আসামিরা সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন না। তখন তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে জজ সাহেবের কাছে সাক্ষীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ চেয়ে অনুমতি নিতে পারেন। জজ সাহেব অনুমতি দিলে তিনি কথা বলতে পারেন’— বলেন নাম প্রকাশ না করে এক আইনজীবী।
গতকাল সোমবার সকাল সোয়া ১০টায় প্রথম দিনের মতো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হলো।
প্রথম দিন মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসের সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। শারমিন ফেরদৌস এদিন আদালতকে বলেন, “লিয়াকত ফোনে বলেছে, ‘টার্গেট ফেলে দিয়েছি, তোরা তাড়াতাড়ি আয়।’ আরেক ফোনে বলেন, ‘স্যার একটাকে ডাউন করেছি, আরেকটারে ধরে ফেলেছি।’ সিনহা পানি ও শ্বাস নিতে চাইলে লিয়াকত গালাগাল করে কোমরে লাথি মেরে ফেলে দেয় এবং মাথা চেপে ধরে। এরপর পুলিশ আসলে লিয়াকত নির্দেশ দেয় আশপাশের মানুষকে ভয় দেখাতে, যাতে কেউ সিনহাকে সাহায্য করতে না পারে। ছবি বা ভিডিও করতে না পারে।”
মামলার বাদী ও প্রধান সাক্ষী আদালতকে আরও বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর প্রদীপ আসে। কাকে যেন ফোন করে, লিয়াকতের সঙ্গে কথা বলে, সিনহার দিকে এগিয়ে যায়, তার বাম পাঁজরে সজোরে লাথি মারে। এরপর সে জুতা দিয়ে বাম গলা চাপ দেয়, তখন সিনহা নড়াচড়া করেন ও কাঁপতে থাকেন। একপর্যায়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রদীপ গলা থেকে পা সরিয়ে নেয়। এরপর রুবেল সাগরকে বলেন, গাড়ি থেকে ইয়াবা, গাঁজা নিয়ে আসতে হবে। রাত ১২টার দিকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আসামিরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে’।
লিয়াকত প্রদীপের প্ররোচনায় ও ফোনে নির্দেশিত হয়ে সিনহাকে গুলি করে। পরে প্রদীপ ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। আদালতের কাছে চার্জশিটে বর্ণিত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাই— আদালতকে বলেন সিনহার বোন।
মঙ্গলবার সকালে শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ। এদিন সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রদীপসহ অন্যদের আনা হলেও কাউকে ফোনে কথা বলতে দেখা যায়নি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি (টেকনাফে দুটি, রামুতে একটি) মামলা করে। পুলিশের মামলায় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকেও আটক করা হয়। পরে নুরকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে তারা জামিনে মুক্তি পান।
৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয় পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।
গ্রেফতার আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এ মামলার মোট সাক্ষী ৮৩ জন।
এমএআর/