জাপানি দুই শিশুর শুনানিতে হাইকোর্টে তুমুল বাহাস
দুই জাপানি শিশু কার হেফাজতে থাকবে, কোথায় থাকবে তা নিয়ে আদালতে শিশুদের জাপানি মা নাকানো এরিকোর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও বাবা বাংলাদেশি শরীফ ইমরানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিমের মধ্যে তুমুল বাহাস হয়েছে। আদালতে তারা টানা এক ঘণ্টা পক্ষে-বিপক্ষে নানান আইনি যুক্তি তুলে ধরেন।
সোমবার (২৩ আগস্ট) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রথমে সকালে দুই শিশুকে সিআইডির হেফাজতে নেওয়ার কথা আদালতের নজরে আনেন শিশুদের বাবার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম। বাচ্চা দুটিকে পিতার হেফাজতে দিতে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন তিনি। এ আবেদনের ওপর বিকেলে দীর্ঘ শুনানি হয়।
শুনানিতে ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বাচ্চা দুটিকে পিতার জিম্মায় তার বাসাতেই রাখার নিবেদন জানান। তিনি বলেন, মা চাইলে সেখানে একজন আইনজীবী বা তত্ত্বাবধায়কের উপস্থিতিতে বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
তিনি বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার কার্যত ডিটেনশন সেন্টার। ওটা শিশুদের জন্য সঠিক স্থান না। প্রয়োজন হলে সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা এ বাসাতেই থাকবেন। তিনি মায়ের পাসপোর্ট আদালতে জমা রাখার নির্দেশনা চেয়ে আবেদন জানিয়ে বলেন, এই মা শিশু দুটিকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন। তাই তার পাসপোর্ট আদালতের কাছে জমা রাখা দরকার।
এ আবেদনের বিরোধিতা করেন শিশুদের মায়ের আইনজীবী শিশির মনির। তিনি বলেন, শিশুদের জন্ম জাপানে। তারা সেখানেই বড় হয়েছে। সেখানের স্কুলে পড়াশোনা করেছে। তারা জাপানি পরিবেশে বড় হয়েছে। তাই তাদের আপাতত জাপানি দূতাবাসে রাখা যেতে পারে। সেখানে পিতা বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করবেন।
তিনি বলেন, এই শিশু দুটি এই জাপানি নারীর গর্ভজাত। সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন শুধুই সন্তানের টানে। মা শিশুদের নিয়ে পালিয়ে যাবেন- এমন কথা পুরোপুরি ভুল। প্রয়োজন হলে মায়ের পাসপোর্ট জমা রাখা হোক।
ফাওজিয়া করিম ফিরোজ এর বিরোধিতা করে বলেন, শিশু দুটি বাংলাদেশি। তারা কেন অন্য দেশের দূতাবাসে থাকবে? দূতাবাসে দিলে তারা আমাদের কোনো কথাই শুনবে না।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে তৃতীয় কোনো উপযুক্ত স্থানে রাখার প্রস্তাব দেন। তবে এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন ফাওজিয়া করিম।
এ সময় আদালত উভয়পক্ষের আইনজীবীকে বিষয়টির সন্তোষজনক সমাধানের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, নাবালক বাচ্চাদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আপনারা ৩১ আগস্টের মধ্যে একটি সন্তোষজনক সমাধান করবেন বলে আশা করব।
আদালত বলেন, আপনারা ইচ্ছা করলে অনেক দূর যেতে পারবেন, দেশি-বিদেশি অনেক আইন ও নজির উপস্থাপন করতে পারবেন। তবে আমাদের চিন্তা একটাই, তা হলো বাচ্চাদের কথা। এখানে বাচ্চারাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
আদালত বলেন, গ্রামে একটি কথা প্রচলিত আছে, তাহলো- পাটা-পুঁতার ঘষাঘষি, মরিচের জীবন শেষ। এখানে বাচ্চা দুটির অবস্থাও তাই।
শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই দুই শিশুকে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দেন। এই সময়ের মধ্যে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জাপানি মা এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশি বাবা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। ৩১ আগস্ট শিশুদেরকে হাইকোর্টে হাজির করতে হবে। ওইদিন আদালত পরবর্তী আদেশ দেবেন।
শুনানিতে অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিমকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার কাজী মারফুল ইসলাম। অ্যাডভোকেট শিশির মনিরকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট সাদ্দাম হোসেন।
গত বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) দুই জাপানি শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা এবং তাদের বাবা শরীফ ইমরানকে এক মাসের জন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে দুই শিশুকে আগামী ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওইদিন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
বৃহস্পতিবার সকালে দুই কন্যা সন্তানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো (৪৬)। রিটে দুই কন্যা সন্তানকে নিজের জিম্মায় নেওয়ার নির্দেশনা চান ওই নারী।
২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো (৪৬) ও বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ে করে টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। তারা তিনজনই টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের শিক্ষার্থী ছিলেন।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান-এরিকোর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ২১ জানুয়ারি ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর একদিন জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে ইমরান তাদের অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
গত ২৫ জানুয়ারি শরীফ ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছ থেকে মেয়েদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মেয়েদের নিজ জিম্মায় পেতে আদেশ চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন।
আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের সঙ্গে এরিকোর সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন। কিন্তু ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়েকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে’ ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে তিনি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে তাদের মা এরিকোর জিম্মায় হস্তান্তরের আদেশ দেন। তবে দুই মেয়ে বাংলাদেশে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। এরপর গত ১৮ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশে এসে এরিকো করোনা পরীক্ষা করালে তার রিপোর্ট নেগেটিভ থাকার পরেও ইমরান ওই রিপোর্ট অবিশ্বাস করে সন্তানদের সঙ্গে তার সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানান। গত ২৭ জুলাই এরিকোর মোবাইল সংযোগ বন্ধ করে চোখ বাঁধা অবস্থায় মেয়েদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। এ অবস্থায় দুই মেয়েকে নিজের জিম্মায় পেতে হাইকোর্টে রিট করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো।
এমএইচডি/এইচকে