ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ১৬ মাসেও আলোর মুখ দেখেনি বিচার বিভাগীয় সুপারিশ
২০১৯ সালে ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। প্রতিদিনই বাড়ছিল আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ঠিক তখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমুটো) হয়ে রুল জারি করেন। রুল শুনানির ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের মার্চে হাইকোর্ট ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বিস্তারে দায়ীদের শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে করণীয় ঠিক করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ১০ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে।
এরপর ১৬ মাস অতিবাহিত হলেও ওই প্রতিবেদনের ওপর কোনো নির্দেশনা আসেনি। উচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রতিবেদনটি এখনও ফাইলবন্দি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করলে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটা বাড়তো না। এ অবস্থায় বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে হাইকোর্ট কোনো নির্দেশনা দিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বিষয়টি শুনানির উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
ওই সময়ে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চে দায়িত্ব পালনকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২০ সালের ৯ মার্চ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তারে দায়ীদের শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করা হয়। এর কিছুদিন পরেই করোনার কারণে আদালত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বতঃপ্রণোাদিত আদেশ প্রদানকারী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি তারিক উল হাকিম পদোন্নতি পেয়ে আপিল বিভাগে চলে যান। ফলে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চটি ভেঙে যায়। এ কারণে পরে বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের ওপর আর শুনানি হয়নি।
বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করলে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ এতটা বাড়তো না। এ অবস্থায় বিচার বিভাগীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে হাইকোর্ট কোনো নির্দেশনা দিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষকে দ্রুত সুয়োমুটো রুলটি শুনানির উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদালত অনেক সময় সুয়োমুটো আদেশ বা রুল জারি করেন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হাইকোর্ট তেমনি একটি আদেশ দিয়েছিলেন। আমি মনে করি সুয়োমোটো রুল ও বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। রাষ্ট্রপক্ষ ভার্চুয়াল কোর্টেই এই শুনানির উদ্যোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় সুপারিশের আলোকে হাইকোর্ট কোনো নির্দেশনা দিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তা অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জনস্বার্থে রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতার কারণে হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করেছিলেন। বিভিন্ন এক্সপার্টদের নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছেন সিটি করপোরেশনগুলোর লুফে নেওয়া উচিত ছিল। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেনি। আমি মনে করি বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনের ওপর পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে শুনানির উদ্যোগ নিতে হবে। আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও আদেশ দিতে পারেন।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে সুয়োমুটো রুল ও বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদন কী অবস্থায় আছে তা খোঁজ নেওয়া হবে। উচ্চ আদালত খুললেই শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৯ মার্চ দাখিল করা বিচার বিভাগীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপের ক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের আংশিক গাফিলতি থাকলেও এককভাবে এই দুই সিটি করপোরেশনকে দায়ী করা যায় না। তাছাড়া অনুসন্ধানকালে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারি প্রকোপের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির একক কোনো গাফিলতি অনুসন্ধান কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়নি।
প্রতিবেদনে ডেঙ্গু রোধে ১০টি সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। যদিও মশার বিরুদ্ধে লড়াই করা সিটি করপোরেশনের কর্তব্য, কিন্তু তাদের পক্ষে একা এটি করা সম্ভব নয়; এটি একটি সমন্বিত উপায়ে করতে হবে, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করতে উচ্চপর্যায়ের (মন্ত্রণালয় পর্যায়ে) একটি তদারকি টিম বা মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে।
এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে দেশের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় এবং সিটি করপোরেশনসহ পৌরসভাগুলোতে নিয়োজিত কর্মকর্তার সমন্বয়ে মশক নিধনের জন্য মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি অঞ্চল, ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রমে ব্যবহৃত কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি মজুদ এবং সংরক্ষণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আলাদাভাবে গুদাম-অফিস নির্মাণ করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ডেঙ্গু যাত্রা ও ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলা হয়, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এর তথ্য মতে বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের অফিসিয়াল প্রাদুর্ভাব ছিল ২০০০ সালে। ওই বছর ৫ হাজার ৫শ ৫১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গু মহামারি রূপ ধারণ করে ২০১৯ সালে। সরকারি হিসেবে ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর এক আদেশে ঢাকা জেলা জজের নেতৃত্বে দুই সদস্যের কমিটিকে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেন আদালত। কমিটির অপর সদস্য হলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবের নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তা। কমিটিকে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে সুপারিশনামা তৈরি করতে বলা হয়। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের একজন করে শিক্ষক, আইসিডিডিআরবি,র একজন বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধি, সরকারের প্লান প্রটেকশন বিভাগের একজন এবং ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের একজন প্রতিনিধিসহ বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে বলা হয় কমিটিকে।
এরপর ২০২০ সালের ১৪ জুলাই বিচারপতি তারিক উল হাকিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এক আদেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ মশাবাহিত রোগ বিস্তার রোধে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ঢাকার দুই মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
এমএইচডি/জেডএস