অসুস্থতার অজুহাতে আটকা সম্রাটের ৪ মামলার বিচার
ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে করা ৪ মামলার কার্যক্রম থমকে আছে। করোনা মহামারি এবং অসুস্থতাজনিত কারণে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির না করায় এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। এক সময়ে রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে চলা মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন সম্রাট।
২০১৯ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসাবিরোধী অভিযান চালানোর পর আত্মগোপনে চলে যান এ মুকুটহীন সম্রাট। এরপর ওই বছরের ৬ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। গ্রেফতারের পর থেকে দেড় বছরের বেশি সময় (২০ মাস) ধরে কারাগারে রয়েছেন সম্রাট। তবে এত দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকায় শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে তাকে থাকতে হচ্ছে বিশেষ প্রিজন সেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে অসুস্থতাজনিত অজুহাতে তাকে আদালতে হাজির না করায় মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তার নিয়মিত চিকিৎসকরা নির্দেশ না দেওয়ায় তারা আদালতে হাজির করতে পারছেন না।
#এক মামলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ড
#তিন মামলায় অভিযোগপত্র
#এক মামলা তদন্তধীন
এর মধ্যে মাদক ও অস্ত্র মামলায় অভিযোগ গঠন আটকে আছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় অভিযোগপত্র আমলে নেওয়া আটকে আছে। মানিলন্ডারিং রিমান্ড শুনানি আটকে আছে।
আদালতে সম্রাটের মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত বছরের (২০২০ সাল) ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশের আদালতে সম্রাটকে হাজির করা হয়। ওই দিন তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলায় অভিযোগপত্র আমলে (গ্রহণ) নেন আদালত। এরপর দুটি মামলায় অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য একই বছরের ৩০ নভেম্বর দিন ধার্য করে মাদক মামলাটি ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এবং অস্ত্র মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন।
এরপর ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ও চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি দুটি ধার্য তারিখে অসুস্থতা জনিত কারণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রিজন সেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনা সম্ভ হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষ সম্রাটকে আদালতে হাজির না করায় দুটি মামলায় পরবর্তী অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৩ জুন দিন ধার্য করেন। একই কারণে মানিলন্ডারিং মামলাটির রিমান্ডও হচ্ছে না।
ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের কারা মহাপরিদর্শক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. মমিনুর রহমান মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সম্রাট এখনও কারাগারের প্রিজন সেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে গত ৯ জুন হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বলেছি তার (সম্রাট) অবস্থা যদি ভালো হয় তাহলে যেন আমাদের কাছে ফেরত দেয়। এ বিষয়ে তারা এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি।’
বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা কেমন সেটা আমরা বলতে পারব না। তবে মনে হয় স্থিতিশীল। হাসপাতালের যে ডাক্তার তাকে নিয়মিত দেখেন তারা আরও ভালো বলতে পারবেন।’
আদালতের গত কয়েকটি ধার্য তারিখে শুনানিতে অসুস্থতাজনিত কারণে হাজির করা হয়নি এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘মূলত তাকে আমরা আদালতে হাজির করেনি বিষয়টি কিন্তু আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত না। যখন হাসপাতালের তার ডাক্তাররা আমাদের বলেন, তাকে এ অবস্থায় আদালতে হাজির করা সম্ভব না। মূলত তখনই আমরা আদালতকে সেই বিষয়ে অবহিত করি।’
সম্রাটের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলায় অভিযোগ
মাদক ও অস্ত্র মামলায় অভিযোগে বলা হয়, ‘যুবলীগ নেতা সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানের সহযোগিতায় মাদকদ্রব্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন। তাদের কাছ থেকে কাছে মোট ১৯ বোতল বিদেশি মদ, যার আনুমানিক দাম ৯৫ হাজার টাকা এবং এক হাজার ১৬০টি ইয়াবা যার আনুমানিক দাম তিন লাখ ৪৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। ওই জব্দকরা মাদকের কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি আসামিরা। এছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব পরিচালনা করতেন সম্রাট। তার নিয়ন্ত্রণেই এসব ক্লাবে ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর বসত। এভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হন এই প্রভাবশালী নেতা। প্রতি মাসে ক্যাসিনো খেলার জন্য সিঙ্গাপুরেও যেতেন তিনি। সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতেন।’
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘আসামিদের নিয়ে অভিযান পরিচালনার সময় সম্রাটের কাকরাইল কার্যালয়ে ক্যাঙ্গারুর দুটি চামড়া ও অস্ত্র পাওয়া যায় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।’
এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর র্যাব বাদী হয়ে রমনা থানায় সম্রাটের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটি মামলা করে।
এরপর একই বছেরর (২০১৯ সাল) ৬ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১ এর উপপরিদর্শক শেখর চন্দ্র মল্লিক অস্ত্র মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
একই বছরের (২০১৯ সাল) ৯ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১ এর উপ পরিদর্শক (এসআই) আ. হালিম মাদক মামলায় সম্রাটের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর গত বছরের (২০২০ সাল) ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ সম্রাটের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্র মামলায় অভিযোগপত্র আমলে (গ্রহণ) নেন। একই সঙ্গে দুটি মামলায় অভিযোগ গঠনের জন্য একই বছরের ৩০ নভেম্বর দিন ধার্য করে মাদক মামলাটি ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এবং অস্ত্র মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন।
এরপর ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ও চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি দুটি ধার্য তারিখে অসুস্থ জনিত কারনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রিজন সেল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে কারাকর্তৃপক্ষ সম্রাট আদালতে হাজির না করায় ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক পরবর্তী অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ৩ জুন দিন ধার্য করেন।
অপরদিকে, অস্ত্র মামলাটিও একই দুটি ধার্য তারিখে (২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ও চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি) একই কারণে কারা কর্তৃপক্ষ সম্রাটকে আদালতে হাজির না করায় ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক পরবর্তী অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আগামী ৩ জুন দিন ধার্য করেন।
সম্রাটের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলায় অভিযোগ
২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মেসার্স হিস মুভিজ নামে কাকরাইলের একটি অফিসে অবস্থান করে অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে সম্রাট। সহযোগী আরমানের মাধ্যমে এসব অর্থ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেন তিনি। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, ফকিরাপুল এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে উপার্জিত এসব অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৯৫ কোটি টাকা।
এছাড়াও অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত সম্রাট সিঙ্গাপুরে ৩৫ বার, মালয়েশিয়ায় তিনবার, দুবাইয়ে দুইবার এবং হংকংয়ে একবার ভ্রমণ করেছেন। এছাড়া তার সহযোগী এনামুল হক আরমান ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১৮ মে পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ২৩ বার ভ্রমণ করেছেন। সম্রাট ও আরমান অবৈধ অর্থ দিয়ে যৌথভাবে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এ ঘটনায় গত বছরের (২০২০ সাল) ১৩ সেপ্টেম্বর সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইম বিভাগের ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের উপ পরিদর্শক রাশেদুর রহমান বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
একই বছরের (২০২০ সাল) ১০ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাফুজ্জামান আনসারী তাদের এ মানিলন্ডারিং মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।
এরপর চলতি বছরের ২৪ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মেহেদী মাকছুদ সম্রাট-আরমানের তিন দিনের আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবুবকর সিদ্দিক শুনানির জন্য ৪ এপ্রিল দিন ধার্য করেন। এরপর এ তারিখে (৪ এপ্রিল) কারা কর্তৃপক্ষ তাদের আদালতে হাজির না করায় পরবর্তী রিমান্ড শুনানির জন্য আগামী ২২ এপ্রিল দিন ধার্য করেন।
সম্রাটের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন অভিযোগে দুদকের মামলায় অভিযোগ
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন দুদক উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম। এরপর দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছরের (২০২০ সাল) ২৬ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
সম্রাটের মামলার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মামলাটি চার্জ গঠনের গত কয়েকটি তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকায় তাকে আদালতে হাজির করেনি কারাকর্তৃপক্ষ। মূলত সে জন্য চার্জ গঠন পেছাল। তবে অসুস্থতা বা অন্যান্য বিষয়টি নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সহ অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনা করব, যেন মামলাটির বিচার দ্রুত এগিয়ে নেওয়া যায়। তাছাড়া গত বছর থেকে এই বছরে করোনা পরিস্থিতির কারণে সব মামলার বিচার একটু দীর্ঘায়িত হচ্ছে।’
টিএইচ/এসএম