জুলাই বিপ্লবের পর পাল্টে গেছে দেশ, পাল্টে গেছে অনেক হিসাব-নিকাশ। ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের পর পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টেও। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসে বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন এসেছে।

নতুন সরকার গঠনের পরপর ফুলকোর্ট সভার নামে জুডিশিয়াল ক্যুর একটা ব্যর্থ চেষ্টা হয়, সেটি ব্যর্থ করে দেন শিক্ষার্থীরা। সেদিন থেকে পরিবর্তনের সূচনা হয় সুপ্রিম কোর্টে। এর মধ্যে স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন নতুন প্রধান বিচারপতি। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও কাজ শুরু করেছে। ধীরে ধীরে জনগণের কাঙ্ক্ষিত বিচার ব্যবস্থার পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

জুডিশিয়াল ক্যুর চেষ্টা ব্যর্থ, একযোগে ৬ বিচারপতির পদত্যাগ

গত ১০ আগস্ট হঠাৎ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভা আহ্বান করেন। খবর রটে যায় ফ্যাসিবাদের দোসর বিচারপতিরা জুডিশিয়াল ক্যু করতে এই ফুলকোর্ট সভা ডেকেছেন। এ খবর জানার পর প্রধান বিচারপতিকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যায়িত করে তার পদত্যাগ এবং ফুলকোর্ট সভা বন্ধের দাবিতে আল্টিমেটাম দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।

সকাল ১১টা থেকে হাজারো ছাত্র জনতা সুপ্রিম কোর্টে জড়ো হতে থাকেন। এরপর ফুলকোর্ট সভা স্থগিত করা হয়। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৭ বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ। শিক্ষার্থীরা তাদের পদত্যাগ দাবিতে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে নানা স্লোগান দেন। সুপ্রিম কোর্ট থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের দুপুর ১টার মধ্যে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেন।

সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা দুপুর ১টার মধ্যে পদত্যাগ না করলে তাদের পরিণতি হবে শেখ হাসিনার মতো। আমরা প্রধান বিচারপতিসহ দলবাজ বিচারপতিদের বাসভবন ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করব। দলবাজ বিচারপতিদের সরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন করা হবে।

পরে বাধ্য হয়ে ওইদিনই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করা অন্য ৫ বিচারপতি হলেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন।

নতুন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে ৫ বিচারপতি নিয়োগ

১০ আগস্ট রাতেই বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেন। এরপর ১২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চারজন বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। তারা হলেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি সৈয়দ জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক।

স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণা

গত ২১ সেপ্টেম্বর জনগণের কাঙ্ক্ষিত বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক রোডম্যাপ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে সারা দেশ থেকে আসা দুই হাজার বিচারকের উপস্থিতিতে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করেন তিনি।

প্রথমেই প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক যুগ-সন্ধিক্ষণে আমাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের জন্য যে কঠিন বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবের কারণে আমার ওপর অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আপনারা- আমার বিচার বিভাগীয় সহকর্মীরা।’

স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় প্রধান বিচারপতির একগুচ্ছ প্রস্তাবনা

প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এজন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য আমি জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।

বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে।

এই অনুচ্ছেদের বুনিয়াদে সংবিধানের কোনো সংশোধন না করেই শুধু রুলস অব বিজনেস এবং বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা বিধান ইত্যাদি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত যেসব বিধিমালা প্রচলিত রয়েছে সেগুলোতে প্রদত্ত 'উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ'-এর সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেখানে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় এর সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় তথা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না। এছাড়াও জেলা আদালতগুলোর বাজেট বরাদ্দের বিষয়টিও তখন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় হতেই নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ন্যায়বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুতক্রমে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। উক্ত প্রস্তাব বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং মঞ্চে উপবিষ্ট আইন উপদেষ্টার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, এই Plan of Action-এ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতকরণে UN Basic Principles on the Independence of the Judiciary-তে বর্ণিত বিধানকে অনুসরণীয় Best practice guideline হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান সময়ই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের শ্রেষ্ঠ সময়।

কাজ শুরু করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন

বিচার বিভাগ সংস্কারের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠক করেছে নবগঠিত কমিশন। বৈঠকে বিচার বিভাগ সংস্কারের শুরুতে এজেন্ডা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংস্কার কমিশনের প্রধানসহ সদস্যরা নিজ নিজ পক্ষ থেকে এজেন্ডার একটি তালিকা প্রণয়ন করবেন। ওই তালিকা ধরে পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা করে এজেন্ডা চূড়ান্ত করা হবে।

গত ৬ অক্টোবর সকালে বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের প্রধান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক (সুপন)। ৮ অক্টোবর মঙ্গলবার কমিশনের পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নের লক্ষ্যে এই কমিশন গঠন করা হয়।

এমএইচডি/এসকেডি