বামে নিহত হাসান মাহমুদ, ডানে বিএনপিপন্থি আইনজীবী মাজেদুর রহমান। ছবি- সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর উত্তর মুগদায় হাসান মাহমুদ নামে শ্রমিক দলের এক নেতা নিহত হন। তার মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করা হয় গত ২৯ আগস্ট। হাসান মাহমুদের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

অভিযোগ উঠেছে, একই ঘটনায় আরেকটি মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছেন মাজেদুর রহমান নামে বিএনপিপন্থি এক আইনজীবী। তিনি নতুন মামলার ড্রাফটে ১৫ নম্বর আসামি হিসেবে সিরাজুল ইসলাম নামে এক আইনজীবীর নাম উল্লেখ করে রেখেছেন। এই বিষয়টি আবার আইনজীবী সিরাজুল ইসলামকে জানিয়ে তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদাও দাবি করেছেন মাজেদুর রহমান। এই টাকা দিলে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে বলে সিরাজুলকে জানান তিনি। আইনজীবী সিরাজুল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। 

এ অভিযোগ শোনার পর ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতারা জানিয়েছেন, অভিযোগ সত্য হলে চাঁদা দাবি করা আইনজীবীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, আন্দোলন চলার সময় গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে উত্তর মুগদার নিজ বাসা থেকে বের হন জাতীয়তাবাদী সড়ক পরিবহন শ্রমিক দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাসান মাহমুদ। ওই রাতে তিনি বাসায় ফেরেননি। তার স্ত্রী অনেক খোঁজাখুঁজি করে জানতে পারেন ৫০/৬০ জন সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী তাকে তুলে নিয়ে গেছেন। পরে তিনি জানতে পারেন খিলগাঁও ছাপরা মসজিদের সামনে রাস্তার ওপর হাসান মাহমুদ পড়ে আছেন। ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে ঘটনাস্থল থেকে হাসান মাহমুদকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় হাসান মাহমুদের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার গত ২৯ আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুর রহমানের আদালতে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। পরে এই পিটিশন মামলা খিলগাঁও থানার ৭ (৮) ২৪ নম্বর এফআইআর হিসেবে গৃহীত হয়।

এখন একই ঘটনায় নতুন করে আরেকটি মামলা দায়ের করতে চান বিএনপিপন্থি আইনজীবী মাজেদুর রহমান। এজন্য তিনি ড্রাফট তৈরি করেছেন বলে নিজেই স্বীকার করেছেন। ওই ‘ড্রাফট’ ঢাকা পোস্টের হাতেও এসেছে।

নতুন ড্রাফটে আসামির সংখ্যা ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৫৪ জন করেছেন মাজেদুর। আগের মামলার আসামি তালিকায় অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের নাম না থাকলেও নতুন ড্রাফটে ১৫ নম্বরে তার নাম দেখা যায়। সেই নাম কেটে দেওয়ার কথা জানিয়েই তার কাছে টাকা চাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সিরাজুল। 

সিরাজুলের কাছে চাঁদা চাওয়া হয় ঢাকার আদালতের দুই জুনিয়র আইনজীবীর মাধ্যমে। তারা ঢাকা পোস্টের কাছে বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন।

এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ২০১৭ সালে ছাত্রলীগের ওই পদ ছেড়েছি। বর্তমানে পেশা হিসেবে ঢাকা জজ কোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পেশাগত কাজে নিয়মিত আদালতে এসেছি। আমাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে এ মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আসামিদের তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দেবে বলে লোক মারফত ১০ লাখ টাকা দাবি করেছেন অ্যাডভোকেট মাজেদুর রহমান। আমি তাতে সম্মত হইনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট মাজেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসান মাহমুদের মৃত্যুর ঘটনায় গত ২৯ আগস্ট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। আরেকটি মামলা রেডি করা হয়েছে, সেটাও হবে।

একই ঘটনার মামলা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা একটা মামলা করেছি। আরেকটা মামলা রেডি আছে, সেটার আসামিদের লিস্ট করা হয়েছে শুধু। পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় এখনও দায়ের করা হয়নি। 

হঠাৎ তিনি কথা ঘুরিয়ে বলেন, একই ঘটনায় দুই মামলা দায়ের হবে না, এটা অন্য একটা মামলা। শুধু ফরম্যাট রেডি করা। 

যদিও তার তৈরি করা ড্রাফটে দেখা গেছে হাসান মাহমুদের মৃত্যুর ঘটনায়ই মামলা করতে চান তিনি।

আসামিদের নাম পরিবর্তন করে চাঁদা দাবির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব ভুল তথ্য, এগুলো সত্য না। 

এ কথা বলে কল কেটে দেওয়ার পর একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি।

নিহত হাসান মাহমুদের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। আমার স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় দুই সপ্তাহ আগে মামলা করেছি। মামলার নম্বর কত বা কত তারিখে মামলা করেছি সেটি মনে নেই।

অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতা ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকীর সঙ্গে। তিনি অভিযোগ ওঠা আইনজীবীকে চিনতে পেরেছেন বলে জানান। 

অ্যাডভোকেট ফারুকী বলেন, মামলা দেওয়ার নামে কারও কাছে চাঁদা চাওয়া ঘৃণ্য একটা কাজ। কোনো আইনজীবী যদি এমন কিছু করে থাকেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা দলের পক্ষ থেকে এমন ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি এবং এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, এমন অভিযোগ আমি আরও পেয়েছি। আমাদের আইনজীবী সমিতিতে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা আছে। কেউ যদি সুস্পষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে লিখিত অভিযোগ জানান তাহলে তার বিরুদ্ধে সমিতির পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আন্দোলনের সময় নিহত হাসান মাহমুদকে অনেকে সাংবাদিক পরিচয়ে চিনতেন। তার স্ত্রীর করা মামলার এজাহারেও পেশা সাংবাদিকতা লেখা হয়েছে। তবে তিনি কোন সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন তা নিশ্চিত হতে পারেনি ঢাকা পোস্ট।

এনআর/এসএসএইচ