চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনার দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতার অ্যান্ড পারিসা ট্রেড সিস্টেমস—এ প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী কেউ এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন আদালত।

আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় বুধবার (১০ জুলাই) চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ৮ আসামির প্রত্যেককে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এসময় পর্যবেক্ষণে এসব বিষয় উল্লেখ করেন।

পর্যবেক্ষণে বিচারক মন্তব্য করেন, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার মতো ফৌজদারি মামলার ঘটনা প্রমাণের কোনো আবশ্যকতা নেই। ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রমাণিত। এতো বিশাল আকারের কর্মযজ্ঞের মধ্যে ৩টি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৩ জন মানুষ মারা যাওয়া ও বহু আহত হওয়ার এই ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় আসামিদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের মৃত্যু হতে পারে এমন ধারণাও আসামিদের ছিল না। প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য, তদন্ত কমিটিসমূহের প্রতিবেদন ও নথিতে রক্ষিত কাগজে এতো বড় দুর্ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের দায় প্রায় পুরোটাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার-পারিসার। কিন্তু প্রতিষ্ঠান একটি বিমূর্ত ধারণা মাত্র। প্রতিষ্ঠানকে সাজা দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত এই দুর্ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মালিক থেকে শুরু করে সব কর্মচারী, যারা যেই পদেই থাকুক না কেন— কেউ দায় এড়াতে পারেন না।

‘এই আসামিরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংঘটিত যে কোনো অপরাধমূলক অবহেলার জন্য দায়ী। এই দায় আসামির ব্যক্তিগত নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক। প্রতিষ্ঠানের সাজা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হুমকির মুখে পড়বে। একইসঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার এই নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর পরিবারের অভিশাপ থেকে এ দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতার অভাব, নির্মাণকারী, ঠিকাদার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে কাজের সমন্বয় না থাকা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো এতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ন্যূনতম নিরাপত্তা পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, দুর্ঘটনার পর ফ্লাইওভার নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের পারস্পরিক দোষারোপ ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরির পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ যে যেকোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃতদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত শ্রেণির এবং এদের অনেকেই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাম্য নয়। ২টি তদন্ত কমিটি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার ও পারিসার ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে বহু অনিয়ম এবং ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছেন, যার দায় আসামিরা ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, একজন ভুক্তভোগীর সাক্ষ্যে এটা প্রমাণিত যে, দুর্ঘটনা সংঘটনের পর সিডিএ কর্তৃপক্ষ ভুক্তভোগীদের ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছেন। যা ঘটনার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতার তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে এ আদালত মনে করে। কোনো প্রাণের ক্ষতিপূরণ অর্থ দ্বারা পূরণ হওয়ার নয়। কারণ এ ঘটনায় মৃত এবং আহত ব্যক্তিদের পরিবার নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘদিন একটি মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা অর্থ দিয়ে পূরণযোগ্য নয়। এছাড়া, ভুক্তভোগীদের অনেকেই শারীরিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়ায় জীবিকা অর্জনে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪৫(১) (বি) ধারার বিধান মোতাবেক, দেওয়ানি আদালতের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখে, আসামিদের প্রত্যেককে ৩ লাখ টাকা করে জরিমানা ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারকে, যার মধ্যে মৃতদের পরিবারকে ১ লাখ টাকা হারে এবং আহতদের পরিবারকে অবশিষ্ট টাকা আনুপাতিক হারে দিলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে বলে এ আদালত মনে করে।

‘আসামিপক্ষের দেওয়া সংশ্লিষ্ট পত্রিকার কপিদৃষ্টে দেখা যায়, দুর্ঘটনার পর সিডিএর চেয়ারম্যান মৃতদের পরিবারকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা করে মোট ৪ লাখ টাকা, পঙ্গুদের ১ লাখ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। কিন্তু, আসামিপক্ষে দেওয়া পত্রিকার কপি একটি ফটোকপিমাত্র, যার মূলকপি চিহ্নিত হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, আর্থিক অনুদানপ্রাপ্ত এমন কোনো মৃতের পরিবারের সদস্য কিংবা গুরুতর আহত কাউকে আসামিপক্ষ থেকে ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়নি। মামলাটি দীর্ঘ ১২ বছরের পুরাতন একটি মামলা এবং আসামিরাসহ ভুক্তভোগী ও ভুক্তভোগীর পরিবার, সাক্ষীরা দীর্ঘদিন যাবৎ ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশায় কোর্টে আসা যাওয়া করছে। ক্ষতিগ্রস্তের দ্রুত বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত না করা রাষ্ট্র এবং বিচারকার্যে জড়িত সবার ব্যর্থতা।

আদালত সূত্রে জানা যায়, রায়ে মামলাটিতে ৮ আসামির প্রত্যেককে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে মামলার একটি ধারায় প্রত্যেককে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৩ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া অন্য একটি ধারায় প্রত্যেককে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতারের সে সময়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম, প্রকল্প প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, আমিনুর রহমান, আব্দুল হাই, মো. মোশাররফ হোসেন রিয়াজ, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজান আলী ও রফিকুল ইসলাম।

আদালত সূত্রে জানা যায়, বিচারিক প্রক্রিয়ায় মামলাটিতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২২ জন। আসামি পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিয়েছেন ৭ জন। সবশেষ গত ২৫ জুন মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে এ রায় দেওয়া হয়।

জানা গেছে, নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জন প্রাণ হারায়। এ ঘটনায় কর্তব্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে ওই বছরের ২৬ নভেম্বর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন এসআই আবুল কালাম আজাদ ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী তানজিব হোসেন ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়।

অন্য আসামিদের মধ্যে ছিলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতার অ্যান্ড পারিসা ট্রেড সিস্টেমসের ১০ জন এবং বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএআরএম অ্যাসোসিয়েটসের ১২ জন। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর পুলিশ আট জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে সিডিএর তিন কর্মকর্তা, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিন জন এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মতিনসহ ১৮ জনের নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

২০১৪ সালের ১৮ জুন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ এস এম মজিবুর রহমান অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আট আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

২০১০ সালে এম এ মান্নান (বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার) ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর ফ্লাইওভারটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভারটি কার্যকর না হওয়ায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরাকান সড়কমুখী র‌্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। ৩২৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়ার র‌্যাম্পটি নির্মাণ শেষে ২০১৭ ডিসেম্বরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

এমআর/এসএম