সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা
বিসিএসের প্রশ্নফাঁস : আসামিদের যে সাজা হতে পারে
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানার মামলায় গ্রেপ্তার ১৭ আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) আইন-২০২৩ এর ১১/১৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
পিএসসি পরিচালিত কোনো পরীক্ষায় ভুয়া পরিচয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁস, উত্তরপত্র প্রতিস্থাপন বা সংযোজন, হলে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা, পরীক্ষায় বাধা দেওয়া ও যেকোনো অপরাধে দায়িত্ব পালনকারী কর্মচারীর সহায়তা— এসব অপরাধের জন্য এই আইনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।
বিজ্ঞাপন
প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গত ৮ জুলাই দিনভর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে পিএসসির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এর আগে, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ওইদিন রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে সিআইডির উপ-পরিদর্শক নিপ্পন চন্দ্র চন্দ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়।
আরও পড়ুন
আদালত সূত্রে জানা যায়, সরকারি কর্ম কমিশন আইনে এটিই প্রথম মামলা। যেখানে আসামিদের বিরুদ্ধে ১১/১৫ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। সেক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিএসসির পরিচালনায় পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নফাঁসসহ যেকোনো অসদুপায় রোধে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ১১/১৫ ধারায় দায়ের করা মামলায় এরইমধ্যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার তদন্তে আরও আসামির নাম উঠে আসতে পারে। এ আইনে অর্থদণ্ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।
অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ দাবি করে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো ভিত্তিহীন। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই তারা জামিনে মুক্ত হবেন এবং বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।
আইনে যা রয়েছে
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইন ২০২৩ এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পরীক্ষার আগে ওই পরীক্ষার জন্য প্রণীত কোনো প্রশ্ন সংবলিত কাগজ বা তথ্য, পরীক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোনো প্রশ্ন সংবলিত কাগজ বা তথ্য অথবা পরীক্ষার জন্য প্রণীত প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিল আছে বলে কোনো প্রশ্ন সংবলিত কাগজ বা তথ্য যে কোনো উপায়ে ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ অপরাধে তিনি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই ধারায় বর্ণিত অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইন ২০২৩ এর ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, পরীক্ষা পরিচালনার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী এই আইনের অধীন কোনো অপরাধে সহায়তা করলে, তিনি যে ধারার অধীন অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করবেন, সেই ধারায় বর্ণিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী বলতে কমিশনের গৃহীত কোনো পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের কথা স্বীকার করেছেন আসামিরা
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সিআইডি জানতে পারে যে, গত ৫ জুলাই পিএসসি আয়োজিত রেলওয়ের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগে একদল নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ও উত্তর বিতরণ করে। গোপন সংবাদ এবং প্রযুক্তির সহায়তায় আসামিরা রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল ও বসুন্ধরাসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে— এমন তথ্য পায় সিআইডি।
পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে একাধিক দল নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে বিগত বছরগুলোতে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র টাকার বিনিময়ে ফাঁস করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা এ তথ্য স্বীকার করেছেন।
১৭ আসামি কারাগারে, ছয়জনের দায় স্বীকার
প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার ১৭ আসামির মধ্যে ছয়জন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দি দেওয়া আসামিরা হলেন, চক্রের সক্রিয় সদস্য পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী (৫২), পিএসসির ডেসপ্যাচ রাইটার মো. খলিলুর রহমান (৩৮), অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম (৪১), ব্যবসায়ী সহোদর মো. সাখাওয়াত হোসেন (৩৪), সাইম হোসেন (২০) ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার (২৫)। এছাড়া, আরেক আসামি ইসিবি চত্বরের ডেভেলপার ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল (৩৫) প্রথমে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত হলেও পরে আবার অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন
গতকাল (৯ জুলাই) দুপুর আড়াইটার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আসামিদের ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারকের খাস কামরায় তোলা হয়। সিআইডি কালো রঙের একটি গাড়িতে করে তাদের আদালতের ফটকের সামনে পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। পরে তাদের দ্রুত বিচারকের খাস কামরার দিকে নিয়ে যায় সিআইডি একটি দল। এ সময় তারা আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। এরপর ঢাকার আলাদা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এছাড়া, একই মামলায় গ্রেপ্তার অন্য ১০ আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়। পরে ১০ আসামির জামিন চেয়ে আবেদন করেন আইনজীবীরা। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হকের আদালত ১০ আসামির জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
কারাগারে যাওয়া আসামিরা হলেন, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান।
এনআর/কেএ