পাঁচ বছরে ১০ নক্ষত্রের বিদায়, আইনাঙ্গনে বিরাজ করছে শূন্যতা
পাঁচ বছরের ব্যবধানে দেশের আইনাঙ্গন থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন আইন জগতের দশ ধ্রুবতারা। দেশ হারিয়েছে প্রখ্যাত আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের। যারা দেশের প্রয়োজনে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতেন। বড় কোনো সাংবিধানিক বা আইনি জটিলতা দেখা দিলে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে মতামত তুলে ধরতেন। এত কম সময়ে প্রথিতযশা দশ আইনজীবীর বিদায়ে আইনাঙ্গনে বিরাজ করছে বড় শূন্যতা।
প্রখ্যাত আইনজীবী বিচারপতি টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন, গরীবের আইনজীবী খ্যাত আব্দুল বাসেত মজুমদার, সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, সাবেক বার সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ড. রফিকুর রহমান— তারা প্রত্যেকেই স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।
বিজ্ঞাপন
তারা ছিলেন আইন জগতের দিকপাল। তাদের কেউ ছিলেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ, কেউ ছিলেন রিট, সিভিল ও কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ, কেউ ছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
আরও পড়ুন
বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের দিকপালদের চলে যাওয়ায় দেশের বিচারাঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে শূন্যতা। এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে বর্তমান আইনজীবীদের। সিনিয়রদের দেখানো পথ অনুসরণ করে কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কম সময়ের ব্যবধানে আমাদের অনেক বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী প্রয়াত হয়েছেন। এছাড়া অনেক সিনিয়র আইনজীবী শারীরিক কারণে আদালতে আসতে পারেন না। এসব কারণে আমাদের বিচারাঙ্গনে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ উনাদের মতো আইনজীবী সৃষ্টি হতে আরও সময় লাগবে।
এখন যারা আইন পেশায় আছেন তাদের মধ্য থেকে একসময় সিনিয়রদের শূন্য জায়গা পূরণ হবে, তবে সময় লাগবে। কারণ যারা প্রয়াত হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা ছিল দীর্ঘ। রফিক উল হক, মাহবুবে আলম, খন্দকার মাহবুব হোসেন কিংবা আবদুল মতিন খসরু—তারা প্রত্যেকেই প্রথিতযশা আইনজীবী ছিলেন। উনারা পরিশ্রম করে তাদের অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তারা আইনকানুন জানতেন, প্রতিনিয়ত পড়তেন, অনুশীলন করতেন।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে তরুণ আইনজীবীদের বলব, আমাদের প্রয়াত সিনিয়ররা যে পথ অনুসরণ করে শীর্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই পথ অনুসরণ করতে হবে। পড়াশুনা, আইনচর্চার বিকল্প নেই। কারণ আপনি যে ১০ জন আইনজীবীর কথা বলেছেন, তারা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। কঠোর পরিশ্রম করে ধাপে ধাপে তারা প্রথিতযশা আইনজীবী হতে পেরেছিলেন।
পাঁচ বছরে দশজন প্রখ্যাত আইনজীবীর মৃত্যুতে আইন জগতে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০ জন মারা গেছেন, তারা প্রত্যেকেই ভালো আইনজীবী ছিলেন। আইনাঙ্গনে তাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা, আমরা পরের প্রজন্ম তাদের থেকে শিখেছি। তারা আজ নেই। এই বিজ্ঞ আইনজীবীদের মামলা করার কৌশল, রেপুটেশন, অভিজ্ঞতা সবকিছু থেকে শেখার অনেক কিছু ছিল।
আইন পেশা এমন একটা পেশা যেখানে সিনিয়র থেকে জুনিয়ররা শিখে থাকেন। তাদের থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। এত কম সময়ের ব্যবধানে ১০ জন প্রখ্যাত আইনজীবীর মৃত্যুতে আইনজগতে অবশ্যই শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা পূরণে আমরা যারা আছি তাদেরকেই ভূমিকা রাখতে হবে। তবে এই শূন্যতা পূরণে সময় লাগবে। আইন পেশায় পড়ালেখার, জ্ঞান চর্চার বিকল্প কিছু নেই। হার্ড ওয়ার্ক করতে হবে। আজ যাদের মৃত্যুতে আইনাঙ্গনে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তারা কিন্তু প্রত্যেকেই নিজেরা পড়ালেখা করে বিখ্যাত আইনজীবী হয়েছিলেন। ব্যক্তির শূন্যতা তো কখনও পূরণ হয় না। নতুন যারা আছেন তাদেরকে এই শূন্যতা যথাসম্ভব পূরণে এগিয়ে আসতে হবে।
এক নজরে আইন জগতের প্রয়াত দশ দিকপাল
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর করোনা আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তিনি মারা যান। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে মাহবুবে আলম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য সংবিধানের ৫ম, ৭ম, ১৩তম, ১৬তম সংশোধনী মামলা; মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মো. কামরুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে আপিলেট ডিভিশনে মামলা পরিচালনা করেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশনে বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মৃত্যু এখনও ভুলতে পারেনি আইনাঙ্গনের মানুষ।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক
২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মারা যান। তিনি বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই নেত্রী যখন কারাগারে তখন তাদের জন্য আইনি লড়াই করেন তিনি। একই সঙ্গে দুই নেত্রীর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় বরাবরই সোচ্চার ছিলেন তিনি। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বর্ষীয়ান এই আইনজীবী। ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রফিক-উল হক। কিন্তু তিনি কোনো সম্মানী নেননি। পেশাগত জীবনে তিনি কখনও কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। তবে, নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা তাকে পাশে পেয়েছেন। রাজনীতিবিদদের সম্মান সবসময়ই অর্জন করেছেন তিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার জীবনের উপার্জিত অর্থের প্রায় সবই ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণ ও সমাজসেবায়। তার মৃত্যু শুধু আইনাঙ্গন নয়, দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
আব্দুল মতিন খসরু
সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু সভাপতির চেয়ার বসার আগেই ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কুমিল্লা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু। একজন আইনজীবী হিসেবে শতভাগ পেশাদার ছিলেন তিনি। কুমিল্লা জজ কোর্ট থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিসে সাফল্য অর্জন করেন তিনি। এরআগে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন আবদুল মতিন খসরু।
১৯৭৮ সালে কুমিল্লা জজ কোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হন তিনি। ১৯৮২ সাল থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন তিনি। সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে সর্বোচ্চ ভোটে সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরবও রয়েছে তার। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন আবদুল মতিন খসরু।
আরও পড়ুন
১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে কুমিল্লা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় বিচারের পথ বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল পাসে আবদুল মতিন খসরুর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তিনি দীর্ঘ দিন আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আমৃত্যু দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন আবদুল মতিন খসরু।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ
প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২০২১ সালের ১৬ মার্চ মারা যান। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। মওদুদ আহমদ দেশের এক বর্ণাঢ্য রাজনীতিক। তিনি আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরশাদ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করে লন্ডনের লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার-এ্যাট-ল' ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনে পড়াশুনা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলনে। ১৯৭৭-৭৯ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৫ এর নির্বাচনে মওদুদ আহমেদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের তথ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এক বছর পর ১৯৮৬ এ তাকে আবার উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৯ সালে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করেন। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে মওদুদ আহমেদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালেও তিনি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মওদুদ আহমেদ নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা থেকে পাঁচবার নির্বাচিত হন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২৪ মে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও মা বেগম আম্বিয়া খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে মওদুদ আহমদ চতুর্থ।
বিচারপতি টি এইচ খান
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, প্রবীণতম আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক আদালতের সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান। ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি বিচারপতি টিএইচ খান মারা যান। টিএইচ খান ১৯২০ সালের ২১ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাধীন ঔটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪২ সালে তৎকালীন কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ (অনার্স) ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৪৬ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। একই বছর ২৭ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সালেহ আকরামের নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারপতি নিয়ে ঢাকা হাইকোর্টের যাত্রা শুরু হয়, সেদিন থেকে বিচারপতি টিএইচ খান একজন আইনজীবী হিসেবে সেই আদালতে (বর্তমান সুপ্রিম কোর্টে) পদচারণা শুরু করেন। তিনি বিচারপতি টিএইচ খান নামে সমধিক পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম মো. তাফাজ্জাল হোসেন খান। ১৯৬৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ১৯৭৩ সালের জুলাই থেকে আবার আইন পেশায় ফিরে আসেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর আইন, শিক্ষা, ধর্ম, ভূমি ও রাজস্ব এবং ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের নেতৃত্বে নতুন সামরিক আইন জারি করা হয়। তখন তিনি আবার আইন পেশায় ফিরে যান। ১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচনে বিরোধিতা করার জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন। বিচারপতি টিএইচ খান ১৯৯২ সালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিএনপির প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান।
১৯৯২ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস কমিশনের মেম্বার এবং একই বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন
প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মারা যান। অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ১৯৩৮ সালের ২০ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি বরগুনা জেলার বামনা উপজেলায়। তিনি ১৯৬৭ সালের ৩১ জানুয়ারি আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত।
খন্দকার মাহবুব হোসেন ২০০৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৬ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদ পান। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-২ আসন থেকে তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ওই আসন থেকে আগেও অন্য দল থেকে একাধিক বার তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
গরীবের আইনজীবী বাসেত মজুমদার
গরিবের আইনজীবী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী আব্দুল বাসেত মজুমদার ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর মারা যান। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
আব্দুল বাসেত মজুমদারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি লাকসামে। ১৯৬৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ১৯৬৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আব্দুল বাসেত মজুমদার বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আব্দুল বাসেত মজুমদার আইনজীবীদের জন্য নিজের নামে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছেন। দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতিতে এ ফান্ড থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ পেশাজীবনে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে আইনি সহায়তা দিয়েছেন তিনি। এ কারণে আইনাঙ্গনে তিনি ‘গরিবের আইনজীবী’ হিসেবে পরিচিত।
আব্দুল বাসেত মজুমদারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার শানিচৌ গ্রামে। হরিচর হাইস্কুল থেকে মেট্রিক (এসএসসি), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম রওশন জাহান মেহেরুন্নেসা। এক ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন আবদুল কাদের ব্যবসায়ী ও আরেক ছেলে সাঈদ আহমদ রাজা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। মেয়ে ফাতেমা আক্তার লুনা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও খাদিজা আক্তার ঝুমা উত্তরা মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।
১৯৬৬ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন আবদুল বাসেত। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, সহ-সম্পাদক, সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হন। বার কাউন্সিলেও নির্বাচিত হয়েছেন কয়েকবার। তার নামে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার আন্দারিপাড়ায় আবদুল বাসেত মজুমদার মাদরাসা ও এতিমখানা এবং গ্রামের বাড়িতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আছে।
ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন
প্রখ্যাত আইনজীবী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর মারা যান। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তথ্য, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং ভূমি মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করেন। মইনুল হোসেন ১৯৭৩ সালে পিরোজপুর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বাকশাল প্রচলন করলে তিনি তার পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পরে তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ পরিচালিত দল ডেমোক্র্যাটিক লীগে যোগ দেন এবং ৩ নভেম্বর মোশতাক সরকারের পতন পর্যন্ত তিনি ডেমোক্র্যাটিক লীগেই ছিলেন।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে ২০০০-২০০১ মেয়াদে নির্বাচিত হন। বিখ্যাত সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার বাবা। তিনি ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তারপর মিডল টেম্পল এ আইন বিষয়ক পড়াশোনা করেন। ১৯৬৫ সালে বার থেকে ব্যারিস্টার-ইন-ল ডিগ্রি অর্জন করেন।
এ জে মোহাম্মদ আলী
প্রখ্যাত আইনজীবী, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী গত ২ মে মারা গেছেন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের দ্বাদশ অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বাবা এম. এইচ. খন্দকার ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। এরপর ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। পরে ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারি অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। এছাড়া তিনি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটিরও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সংবিধান রিট, সিভিল আইন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ডক্টর রফিকুর রহমান
সাত দশকের আইন পেশার ইতি ঘটিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ডক্টর রফিকুর রহমান গত ৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন। রফিকুর রহমান ১৯৫৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি পড়াশোনা করেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের লিংকনস ইনে। তিনি ১৯৮০-১৯৮১ ও ১৯৯১-১৯৯২ সেশনে দুবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এমএইচডি/এমএসএ