বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ের পর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও হাইকোর্টে এখনও নিষ্পত্তি হয়নি দেশজুড়ে আলোচিত চারটি হত্যা মামলা। উচ্চ আদালতে মামলাগুলোর বিচার শেষ না হওয়ায় রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, এরইমধ্যে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে নুসরাত হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হয়েছে। ডেথ রেফারেন্সের ক্রম অনুযায়ী অন্য তিন মামলার শুনানিও পর্যায়ক্রমে শুরু হবে।

নুসরাত হত্যা মামলা ছাড়া অপর মামলাগুলো হলো- রিফাত হত্যা মামলা, অভিজিৎ হত্যা মামলা ও দীপন হত্যা মামলা।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এরইমধ্যে নুসরাত হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হয়েছে। বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলাটির আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। অন্যান্য মামলাগুলোও পর্যায়ক্রমে শুনানি শুরু হবে। প্রধান বিচারপতি সালের ক্রম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো বিভিন্ন বেঞ্চে নিষ্পত্তির জন্য পাঠাচ্ছেন। সে অনুযায়ী শুনানি হচ্ছে। 

চাঞ্চল্যকর মামলা শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ নাকচ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই। চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময় পর্যন্ত নেয় না। এসব মামলা হাইকোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তি হোক, এ বিষয়ে আমরা আন্তরিক।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। এখন উচ্চ আদালতে শুনানির জন্য হাইকোর্টের বিভিন্ন ফৌজদারি বেঞ্চে এসব মামলা পাঠানো হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে এসব মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হবে।’ 

নুসরাত হত্যা মামলা : ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলার রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে হত্যার দায়ে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্সের জন্য মামলার রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে। মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুত শেষে ২০২০ সালের ২ মার্চ আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি। নুসরাত হত্যা মামলায় দণ্ডিত সব আসামি আপিল করেছেন।

২০১৯ সালের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় সোনাগাজী থানায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তারের করা মামলায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় বোরকা পরা দুর্বৃত্তরা।

আগুনের ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ নুসরাত ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অগ্নিসন্ত্রাসের এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

রিফাত হত্যা মামলা : বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলা হাইকোর্টে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে। এ হত্যা মামলায় ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান প্রাপ্ত বয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পাশাপাশি ৬ আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেন। বাকি ৪ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

২০২০ সালের ৪ অক্টোবর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মিন্নিসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ডের গড়া কিশোর গ্যাং ‘বন্ড গ্রুপ’। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ২ জুলাই মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

অভিজিৎ হত্যা মামলা : বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলা এখন হাইকোর্টে। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়াসহ পাঁচ জঙ্গির ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথি হাইকোর্টে আসে।

২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান।

রায়ে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। অপর আসামি উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।

দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে জিয়া, সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিবকে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলার রায়েও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

দীপন হত্যা মামলা : জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলা এখন উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এখন আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ফাঁসির রায় দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। রায়ে আট আসামির সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। 

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামি হলেন- মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির, আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল রিফাত, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব সাজিদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন, শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের, চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব। তাদের মধ্যে জিয়াসহ দুজন পলাতক রয়েছেন।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগ এলাকার আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে ফয়সল আরেফিন দীপনকে ঘাড়ের পেছনে আঘাত করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা অফিসের দরজা বন্ধ করে পালিয়ে যায়। মামলাটি তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।

এমএইচডি/জেডএস