মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক গ্যারিসন লুট্রেলকে বাংলাদেশি নাগরিক ফারহানা করিমের দেওয়া তালাকের নোটিশকে অবৈধ ঘোষণা করে এর কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন ঢাকার দেওয়ানি আদালত।

বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) ঢাকার ৬ষ্ঠ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের বিচারক এই নিষেধাজ্ঞা দেন। গ্যারিসনের আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আদেশে বলা হয়েছে, ‘গ্যারিসন লুট্রেল তার স্ত্রীর নিকট হতে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৭(১) ধারা মতে একটি নোটিশ প্রাপ্ত হন। উক্ত নোটিশে ২ নং বিবাদী(কাজী) সিল ছিল। ৩ নং বিবাদীর ( আরবিট্রেশন কাউন্সিল) কাছে পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়— ১ নং বিবাদীর(ফারহানা করিম) নোটিশের প্রেক্ষিতে সালিশি কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়েছে। যেহেতু, ১ নং বিবাদীর সাথে বিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিসোরি অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেহেতু উক্ত তালাক কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাদী মোকদ্দমা দায়ের করেন। যেহেতু, ৩ নং বিবাদী কর্তৃক সালিশি কার্যক্রম সম্পন্ন হলে বা ২ নং বিবাদী কর্তৃক তালাক নিবন্ধিত করা হলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতিসহ মোকদ্দমার কারণ ব্যাহত হবে সেহেতু উক্ত তালাকের কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত আনয়ন করে বাদী বিজ্ঞ আদালতে বিবাদীদের প্রতি নির্দেশনা প্রার্থনা করেন।’

‘বাদীর(গ্যারিসন) ১৫১ ধারার দরখাস্তমতে- যেহেতু বাদী ও ১ নং বিবাদীর বিবাহ বাংলাদেশের বাইরে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, ১ নং বিবাদী কর্তৃক প্রেরিত তালাকের নোটিশটি মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১- এর আলোকে অবৈধ মর্মে বিজ্ঞ আদালতের দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। অতএব নোটিশ এবং সালিশি কার্যক্রম আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ। বিজ্ঞ আদালত সে মর্মে ২ ও ৩ নং বিবাদীগণদের যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ প্রদান করেন।’

এর আগে গত ২৮ নভেম্বর আমেরিকান বাবা গ্যারিসন লুটেল সপ্তাহে দুইদিন তার তিন বছরের ছেলে সন্তানকে দেখতে যেতে পারবেন বলে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ঢাকার উত্তরা ক্লাবে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার শিশুর মা ফারহানা করিম শিশুকে নিয়ে আসবেন। বেলা ১১ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শিশু মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকবেন। সেখানে বাবা গ্যারিসন লুটেল সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।

সেদিন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। তবে আরেক সন্তানের বয়স একমাস হওয়ায় তাকে দেখার বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি আদালত।

তার আগে রুদ্ধদ্বার কক্ষে আমেরিকান বাবা গ্যারিসন লুটেল ও বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমের বক্তব্য শোনেন আদালত। 

প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন সন্তানদের কোনো খোঁজ না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসেন আমেরিকান বাবা গ্যারিসন। সন্তানদের আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট দুই শিশু সন্তানসহ তাদের বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমকে আদালতে হাজির করতে বলা হয়। উত্তরা থানা পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

ওইদিন আদালতে আমেরিকান বাবার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তাকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ।

পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী গ্যারিসন লুটেল। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফারহানা করিমকে ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। ঢাকার উত্তরাতে তাদের বাসা। ফারহানা স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করেন। তিন বছর আগে তাদের প্রথম একটি সন্তান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফারহানা ও গ্যারিসনের নিজস্ব বাসা ছিল। এ বছরের শুরুর দিকে ফারহানা আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জুন মাসে ফারহানা করিম বাংলাদেশে চলে আসেন। অন্তঃসত্ত্বা সময় তার বোন-মায়ের সঙ্গে থাকা জরুরি এই অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আসার পর তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে গ্যারিসন ফারহানাকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিলেন।

কিন্তু পরে দেখলেন, অনেকদিন হয়ে গেছে যোগাযোগ করছে না। কোনো আপডেট দিচ্ছে না। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চেষ্টা করেছেন যোগাযোগ করতে, কিন্তু পারেননি। যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে অক্টোবর মাসে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু ফারহানা দেখা করতে চান না, বাচ্চারাও দেখাতে চান না। একপর্যায়ে উত্তরা থানার পুলিশ ও গ্যারিসন যে হোটেলে থাকতেন তাদের সহযোগিতা নিয়ে ফারহানার বাসায় যান। বাসায় গিয়ে জানতে পারেন— ফারহানা করিম কানাডিয়ান একজন ব্যক্তির সঙ্গে বসবাস করছেন। তিনি কানাডিয়ান ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করেছেন বলে দাবি করেন। এদিকে, এক মাস আগে আরেকটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছেন ফারহানা।

আইনজীবী বলেন, সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, তিনি গ্যারিসনকে হাসপাতালের কাগজ দেখিয়ে বলেছেন দ্বিতীয় সন্তান গ্যারিসনের না। এ সন্তান তার পার্টনার কানাডিয়ান নাগরিকের। তিনি একটা ম্যারেজ ডকুমেন্ট দেখিয়ে বলেছেন, কানাডিয়ান নাগরিককে বিয়ে করেছেন। কিন্তু আমেরিকান নাগরিক গ্যারিসনের সঙ্গে তার এখনো ডিভোর্স হয়নি। গ্যারিসনের বাংলাদেশে আসার অন্যতম কারণ– পুরান ঢাকার একজন কাজী যুক্তরাষ্ট্রে একটি কাগজ পাঠায়। সেটি তালাকের নোটিশ। মুসলিম পারিবারিক আইনে একটি তালাকের নোটিশ পাঠান। নোটিশ দেখে গ্যারিসনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ বলেন, আমরা আদালতে বলেছি, নোটিশটা ইনভ্যালিড। কারণ তাদের বিয়ে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব মিসোরির আইন অনুযায়ী। ডিভোর্স হলে স্টেট আইনে হতে হবে।

এদিকে বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে যান। সিটি কর্পোরেশন থেকে কাগজপত্র দেখে তারা বলেন, আসলে এটা তো এভাবে হয় না। আমরা তারপর কাজীর কাছে গিয়েছি। তিনি খুব বেশি সহযোগিতা করেননি। তিনি আমাদের থেকে একটি দরখাস্ত রেখেছেন। বিয়ে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী। অথচ তিনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন মুসলিম পারিবারিক আইনে, এটা তিনি আইনত পারেন না। আর নোটিশ যখন ইস্যু করা হয়েছে তখন ফারহানা অন্তঃসত্ত্বা।

তিনি আরও বলেন, অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তো নোটিশ পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। নোটিশের বিষয়ে তিনি দেওয়ানি মামলা করেছেন।

এমএইচডি/এমজে