হাইকোর্টের এজলাস কক্ষে দাঁড়িয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেছেন, আমার মমতাময়ী মা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য আমার লিভার, কিডনি, এমনকি জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি। আমার ১০০ বছরের সাজা হলেও আমি ভয় পাই না।

বুধবার (২২ নভেম্বর) বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. বশির উল্লার বেঞ্চে তিনি এ মন্তব্য করেন।

টকশোতে হাবিবুর রহমান হাবিব যে বক্তব্য দিয়েছিলেন শুনানির শুরুতে ল্যাপটপের মাধ্যমে তা দেখানো হয়। আদালতের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি শপথ করে বলছি আমি এই বক্তব্য দিয়েছি। আমি আদালতের কাছে কিছু কথা বলতে চাই। তখন হাইকোর্ট তাকে কথা বলার অনুমতি দেন।

বিএনপির এই নেতা বলেন, ২০০৯ সালে আমি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখন আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। এক কোটি টাকার উপরে প্রয়োজন ছিল আমার লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে। তখন সেসময়ের বিরধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া আমাকে সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিলেন লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করাতে। কিন্তু পরে আমার লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে হয়। এখন সেই খালেদা জিয়ার জীবন বিপন্ন। ওনার লিভারে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি আগেই বলেছি খালেদা জিয়ার জন্য লিভার লাগলে আমি আমার লিভার দিয়ে দেব। তাকে এই বয়সে সাজা দেওয়া হয়েছে। তার প্রতি আমার আবেগ থেকে আমি ওই (আদালত অবমাননার অভিযোগে আনা) কথাটা টিভি টকশোতে বলেছি। এতে ১০০ বছর সাজা হলেও আমি ভয় পাই না।

একপর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে হাবিবুর রহমান হাবিব হাইকোর্টকে বলেন, আমি একটি ভাড়া বাসায় থাকি, যে বাসায় লিফট নেই। আমি সারাজীবন স্বচ্ছ রাজনীতি করেছি। আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে বিচার দিয়ে যাচ্ছি... যে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছে সেই গাড়ি পোড়েইনি। আজ নিম্ন আদালতগুলোতে যেভাবে বিচার করা হচ্ছে, মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে, এটা চলতে পারে না। আমি আইন-আদালত মানি। কিন্তু অন্যায় রায়-বিচার আমি মানি না। আপনারা সবকিছু বিবেচনা করে যেটা ভালো মনে করবেন সেটিই করবেন। আমাকে সাজা দিলেও আমি আপনাদের সালাম জানাব এবং আমি সেই সাজা মাথা পেতে নেব।

বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান বলেন, আপনার কথা শুনলাম। আপনার কথায় আবেগ আছে। কিন্তু এটা সবারই মনে রাখা উচিত যে, বিচারক ও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছ থেকে এমন বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। যে বক্তব্য পুরো বিচারবিভাগের মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করেছে। আদালতের কোনো রায়ে সন্তুষ্ট না হলে সে রায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া আদালত অবমাননাকর। সবারই তার নেতার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে হাবিবুর রহমান হাবিবের যে বহিঃপ্রকাশ তা পুরো বিচার বিভাগের মর্যাদার প্রতি অবমূল্যায়নকর।

হাইকোর্ট বলেন, রাজনীতিবিদেরা সমাজের শিক্ষক। তারা নেতৃত্ব দিয়ে সমাজকে একত্রিত করতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে স্মরণ করতে পারি। তিনি কীভাবে একটা জাতিকে একত্রিত করেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ রাজনীতিবিদরা নেতৃত্বের এই শক্তিটা ধারণ করতে পারেন। সুতরাং একজন রাজনীতিবিদের এটাই ভাবা উচিত যে তিনি সমাজের একজন শিক্ষক।

হাবিবুর রহমান হাবিবকে হাইকোর্ট জিজ্ঞেস করেন যে, আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা? জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি মুক্তিযোদ্ধা তবে সার্টিফিকেট নেইনি। তখন আদালত বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে এমন মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত।

কিছু কিছু শাস্তি সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, উনি যেভাবে বলেছেন তা আমাদের হৃদয়কেও ছুঁয়েছে। উনি সাহসের সঙ্গে বলেছেন। উনি মিথ্যা বলেননি, উনি অস্বীকার করেননি। এরকম নজির আমরা সাধারণত দেখি না। উনি ওনার বলার অবস্থান থেকে পিছিয়ে যাননি। উনি টকশোতে যা বলেছেন সেটি এখানে আবার দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকার করেছেন। উনি বলেছেন উনি ওনার নেত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। উনি এটাও বলেছেন যে, উনি তাকে মায়ের মত ভালোবাসেন। এটা ওনার আবেগের প্রকাশ। 

বিচার বিভাগ সবকিছু দেখে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না এবং এতে সমাজে ভুল বার্তা যায় উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, আমরা একটা শাস্তি দিয়েছি, যেটাতে এই বার্তা যাবে যে আদালত ও বিচারককে নিয়ে এভাবে বলা যায় না। কথার একটা সীমা থাকতে হয়। শুনানি শেষে আদালত তাকে ৫ মাসের কারাদণ্ড দেন ও ২ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

আদালতে হাবিবুর রহমান হাবিবসহ তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব, ব্যারিস্টার এহসানুর রহমান ও অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি উপস্থিত ছিলেন। এর আগে, দুপুরে তাকে হাইকোর্টে হাজির করে শেরে বাংলা নগর থানা পুলিশ।  

গত ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় তার ব্যাখ্যা দিতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে তলব করেন হাইকোর্ট। ৬ নভেম্বর তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়। একইসঙ্গে আদালত অবমাননার দায়ে তার বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।

৬ নভেম্বর আদালতে হাজির হননি তিনি। যে কারণে ৮ নভেম্বরের মধ্যে তার বর্তমান অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে ৮ নভেম্বরের মধ্যে এ তথ্য জানাতে বলা হয়।

৮ নভেম্বরও আদালতের তলবে হাজির না হওয়ায় হাবিবকে ধরে হাইকোর্টে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে তাকে হাজির করতে পুলিশের আইজিসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) রাজধানীর পল্লবী থানার মিরপুর ডিওএইচএস এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে বুধবার দুপুরে তাকে হাইকোর্টে হাজির করে শেরে বাংলা নগর থানা পুলিশ।

এর আগে, পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে তার পাবনার ও ঢাকার বাসায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক মামলায় সাজা হওয়ার পর থেকেই তিনি পলাতক আছেন। পাবনা জেলা পুলিশ ও ডিএমপির শ্যামলী থানা পুলিশ হাইকোর্টকে এ তথ্য জানায়।

এমএইচডি/কেএ