আপিল বিভাগের আদেশে তিন বছরের আইনি লড়াইয়ের পর ৫ বছরের শিশু সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিক মা সাদিকা সাঈদ। তবে শিশু সন্তানকে নিয়ে আদালতের অনুমতি ছাড়া তিনি বাংলাদেশের বাইরে যেতে পারবেন না। আর বাবা সপ্তাহে দুই দিন সন্তানকে দেখতে যেতে পারবেন।

অন্যদিকে, সন্তানকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ায় শিশুটির বাংলাদেশি বাবা শাহিনুর টি আই এম নবীকে জামিন দিয়েছেন আদালত।

সোমবার (৬ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে শিশুটির মায়ের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ও ব্যারিস্টার কাজী মারুফুল আলম। বাবার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুন্সি মনিরুজ্জামান।

পরে শিশুটির মা সাদিকা সাঈদ বলেন, বাংলাদেশের আদালত ও প্রধান বিচারপতির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার আইনজীবীদের কাছেও কৃতজ্ঞ। আমি ন্যায় বিচার পেয়েছি।

২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর ভারতীয় নাগরিক সাদিকা সাঈদের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের তিন বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক বাবা শাহিনুর টি আই এম নবীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন  হাইকোর্ট। শিশুকে নিয়ে বাবা শাহিনুর যেন দেশের বাইরে যেতে না পারেন সেজন্য ইমিগ্রেশন পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

ওই দিন শিশুটির বাবার পক্ষে আইনি লড়াই থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। কারণ, ওই শিশুকে মায়ের আইনজীবীর কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু শিশুর বাবা আইনজীবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। এ কারণে আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন।

২০২১ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট দুই মাসের জন্য ওই শিশুকে ভারতীয় নাগরিক মা সাদিকা সাঈদের হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, মা ও শিশু মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্লাড) ব্যবস্থাপনায় থাকবে। তবে, বাংলাদেশি বাবা সপ্তাহে তিন দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শিশুর সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। এ দুই মাস সাদিকা সাঈদের পাসপোর্ট গুলশান থানায় জমা রাখতে বলা হয়।

শিশুর মায়ের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পর শিশুর বাবা তার সন্তানকে উন্নত পরিবেশে গুলশান ক্লাবে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শিশুর মঙ্গলের কথা চিন্তা করে আমরাও রাজি হই। গুলশান ক্লাবেই মা ও শিশু অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে তিন বছরের ওই শিশুকে বেড়ানোর কথা বলে গুলশান ক্লাব থেকে নিয়ে যান বাবা শাহিনুর। পরে আর মায়ের কাছে দিয়ে যাননি। এর মধ্যে শিশুর মায়ের বিরুদ্ধে জিডি ও মামলা করেন শাহিনুর।

এ বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে আদালত মঙ্গলবার সকালের মধ্যে শিশুকে আদালতে হাজির করতে বলেছিলেন। কিন্তু আদালতের আদেশ প্রতিপালন করা হয়নি।

আইনজীবী কাজী মারুফুল আলম বলেন, আমরা জানতে পারি শিশুকে নিয়ে তার বাবা অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হলে হাইকোর্ট তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি লাখ টাকা জরিমানা করেন। সম্প্রতি শিশুর বাবা দেশে ফিরে এসে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে আপিল বিভাগে জামিন আবেদন করেন শিশুর বাবা শাহিনুর টি আই এম নবী। শিশুটিকে মায়ের কাছে ফেরত দেওয়ার শর্তে আপিল বিভাগ তাকে জামিন দেন। তবে, জরিমানার আদেশ বহাল রয়েছে বলে জানান আইনজীবীরা।

তারা বলেন, ভারতের বিয়ে সংক্রান্ত ওয়েব সাইট থেকে অন্ধপ্রদেশের হায়দরাবাদের সাদিকা সাঈদ শেখ নামে এক মেয়েকে বিয়ের জন্য পছন্দ করেন ঢাকার বারিধারার এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান শাহিনুর টি আই এম নবী। মেয়েটি হায়দারাবাদের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান।

২০১৭ সালে হায়দারাবাদে তাদের ঘটা করে বিয়ে হয়। বিয়ের পর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাস শুরু করেন তারা। কয়েক মাস পর ঢাকায় চলে আসেন। এর মধ্যে এ দম্পতির ঘরে ২০১৮ সালে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। একপর্যায়ে তাদের সংসারে অশান্তি নেমে আসে। সাদিকা শেখকে মারধরও করেন তার স্বামী শাহিনুর। তাকে ভারতের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

বিষয়টি ভারতে মেয়েটির আত্মীয়-স্বজনরা জানতে পারেন। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করা হয়। তারপরও সমাধান হয়নি। পরে মেয়েটির বোন মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্লাড) কাছে আইনি সহায়তা চান।

২০২১ সালের ৮ আগস্ট সাদিকা শেখ ও তার শিশুসন্তানসহ আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হেবিয়াস কর্পাস (অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করে রাখা) রিট করে ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ফ্লাড) পরিচালক ব্যারিস্টার কাজী মারুফুল আলম ও ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক লুলান চৌধুরী।

হাইকোর্টে মামলা দায়ের করার পরপরই বাংলাদেশি নাগরিক শাহিনুর টি আই এম নবী ভারতীয় নাগরিক সাদিকা সাইদকে ডিভোর্স দেন।

এমএইচডি/এসএসএইচ