সকালে সাজা, দুপুরে জামিন, বিকেলে রায় স্থগিত—আইন কী বলে?
আদালত অবমাননার দায়ে কুমিল্লার সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সোহেল রানাকে বৃহস্পতিবার সকালে এক মাসের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। তার ৩ ঘণ্টার মাথায় দুপুরে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ তাকে জামিন দেন। আবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের দেওয়া সাজা স্থগিত করে দেন।
একইদিন একজন বিচারকের সাজা, জামিন ও সাজা স্থগিত হওয়ার ঘটনা আইন অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। তবে এখানে আইনি কোনো ব্যত্যয় হয়নি বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপিল বিভাগের চেম্বার জজ যদি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তাহলে যেকোনো সময় যেকোনো আদেশ স্থগিত করতে পারেন। এমন বহু নজির রয়েছে।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, দ্রুত আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়নি। সকালে আদেশ হওয়ার পর রাতে সেই আদেশ চেম্বার আদালতে স্টে (স্থগিত) হওয়ার নজির রয়েছে। তবে একজন বিচারকের ক্ষেত্রে আজ যেটা হয়েছে, তা দেখতে একটু বেমানান লাগছে। কারণ বিচারককে সকালে সাজা দেওয়ার পর দুপুরে হাইকোর্ট তাকে ৩০ দিনের জামিন দিয়েছেন। এটা এত জরুরি ছিল না যে চেম্বার আদালতে আজকেই যেতে হবে। আজ তো নিয়মিত চেম্বার আদালত ছিল না। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় চেম্বার আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এত জরুরি বিষয় ছিল না যে ৩০ দিনের বেইল থাকা অবস্থায়ও আজকের মধ্যেই চেম্বার কোর্টে গিয়ে স্টে করাতে হবে।
অভিযুক্ত বিচারক সোহেল রানার আইনজীবী শাহ মঞ্জরুল হক বলেন, হাইকোর্ট সকালে সাজার আদেশ দেন। দুপুরে জামিন দেন। এর মধ্যে আমরা আপিল বিভাগে আবেদন করি। তারপর চেম্বার বিচারপতির খাস কামরায় যাই। চেম্বার বিচারপতি খাস কামরায় ছিলেন। আমরা পারমিশন চাইলাম। তিনি বললেন, মামলার রেকর্ড নিয়ে আসেন। আমরা নিয়ে গেলাম। এরপর চেম্বার আদালত হাইকোর্টের দেওয়া কারাদণ্ডের রায় ২০ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেন।
সাজা দেওয়া, জামিন দেওয়া, সাজার রায় স্থগিত হওয়া— একইদিনে একই মামলার তিন রকম আদেশ হলো। বিষয়টি ‘সুপারসনিক’ গতিতে হয়েছে কি না— এ প্রশ্নের জবাবে শাহ মঞ্জরুল হক বলেন, এখানে সুপারসনিক কিছু হয়নি। যা হয়েছে একদম অ্যাজ ই্উজুয়াল হয়েছে। বলতে পারেন একটু দ্রুত হয়েছে। আমি অনেক বড় বড় মামলা করেছি। এ ধরনের বহু অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। এটা আমার জন্য প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। বহু মামলার দুপুরে রায় হয়েছে, বিকেলে চেম্বার জজ আদালত স্থগিত করেছেন।
আরও পড়ুন
জামিন দেওয়া প্রসঙ্গে এ আইনজীবী বলেন, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির একটা প্রভিশন আছে ৪২৬(২)— এ ধারায় সাজা যদি এক বছর বা তার চেয়ে কম হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট আদালত অর্থাৎ যে আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন সেই আদালত তার জামিন মঞ্জুর করতে পারেন। এই প্রভিশন অনুযায়ী আমরা সাজা প্রদানকারী বেঞ্চে আপিল করার শর্তে জামিন আবেদন করি। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে জামিন দেন।
সারাদিনে যা হলো
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আদালত অবমাননার অপরাধে কুমিল্লার সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত) মো. সোহেল রানাকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ৭ দিনের মধ্যে তাকে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
এই রায়ের তিন ঘণ্টার মাথায় হাইকোর্টের একই বেঞ্চ তাকে ৩০ দিনের জামিন দেন। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার শর্তে তাকে জামিন দেওয়া হয়।
এর মধ্যে হাইকোর্টের সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন বিচারক মো. সোহেল রানা। সেই আবেদন নিয়ে বিকেল সোয়া ৫টার সময় চেম্বার আদালতের খাস কামরায় যান সোহেল রানার আইনজীবীরা। খাস কামরায় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শুনানি শেষে চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টের সাজার রায় ২০ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেন। একইসঙ্গে আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানির জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
এভাবে উচ্চ আদালতে একটি ঘটনাবহুল দিনের সমাপ্তি ঘটে।
বিচারকের আদালত অবমাননার প্রেক্ষাপট
মামলার নথি থেকে জানা যায়, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামুন চৌধুরী ও রিয়া আক্তার দম্পতির বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা হয়। মামলার কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে মামুন-রিয়া দম্পতির করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। একইসঙ্গে মামলার কার্যক্রম চার মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট।
২০১৯ সালের ৬ মার্চ রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এ স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও কুমিল্লার তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা গত ১০ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযোগ গঠন করেন।
উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে মামলার কার্যক্রম চালানো এবং অভিযোগ গঠন করায় বিচারক সোহেল রানার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে অভিযোগ করেন আসামি মামুন চৌধুরী।
গত ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট এক আদেশে বিচারক সোহেল রানাকে তলব করেন। উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করার বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ২১ আগস্ট তাকে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। ধার্য তারিখে তিনি হাইকোর্টে হাজির হন। পরবর্তী সময়ে জবাব দাখিল করেন। তবে জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় গত ২৮ আগস্ট সোহেল রানার প্রতি আদালত অবমাননার স্বপ্রণোদিত রুল দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ৯ অক্টোবর তাকে হাইকোর্টে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত অবমাননার রুলের পর গত ৩১ আগস্ট বিচারক সোহেল রানা কুমিল্লার সেই মামলার অভিযোগ গঠনের আদেশ প্রত্যাহার করেন। হাইকোর্টের ধার্য তারিখে হাজির না হয়ে তিনি সময়ের আবেদন জানান। হাইকোর্ট আজ ১২ অক্টোবর পরবর্তী তারিখ ঠিক করেন।
সে অনুযায়ী বিচারক সোহেল রানা আজ হাইকোর্টে হাজির হন এবং আদালত অবমাননার বিষয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তার ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ না করে হাইকোর্ট কারাদণ্ড দেন এবং জরিমানা করেন।
এমএইচডি/এমজে