বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আক্ষেপ করে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ বলেন, আমি বিএনপি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমার ছোট ভাই (কাউন্সিলর খোরশেদ আলম) ফোন দিয়ে কান্না করছেন। মেয়ে ব্যারিস্টার মার-ই য়াম খন্দকার অভিমান করে আছেন। কিন্তু আমার তো করার কিছু নেই!

সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের নিজ চেম্বারে ঢাকা পোস্টের কাছে আক্ষেপ করে এসব কথা বলেন তিনি। প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ বলেন, ‘দেড় বছর আগে বিএনপি বহিষ্কার করেছে। তারপর বিএনপির কেউ একটিবারের জন্য ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেয়নি। কোনো মূল্যায়ন করেনি। এখন আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য তো একটি প্লাটফর্ম দরকার।’

‘ছোট ভাই বিএনপিতে আছে, তারা বিএনপি করবে। আমার ১৪ গোষ্ঠী বিএনপির সঙ্গে জড়িত। দল আমার প্রতি সুবিচার করেছে , নাকি অবিচার করেছে, জাতি সেটা দেখবে। আমাকে দেড় বছর আগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারপর এক দিনের জন্যও ডাকেনি। এখন ডাকার কোনো সম্ভাবনা দেখি না।’

আরও পড়ুন : ধীরে-ধীরে দলে হারিয়ে যাচ্ছে খালেদা জিয়ার আবেদন!

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে তৈমুর আলম খন্দকারের প্রচারণা / ফাইল ছবি

রাজপথের কর্মীর প্রতি কি এমন আচরণ হওয়া উচিত— প্রশ্ন রেখে এ রাজনীতিক বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় নির্বাচনের দুই দিন আগে অব্যাহতি দেওয়া হলো। শোকজ কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হলো না। বহিষ্কারের পরও নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে গিয়েছি। আমি গুলি খাওয়া লোক। আওয়ামী লীগের লোকেরা ঘোষণা দিয়েছিল, মিছিলে গুলি হবে। আমি বলেছিলাম, গুলি হলেও মিছিল হবে। মিছিল থেকে পুলিশ কখনও আমার হাত থেকে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ছবিসম্বলিত ব্যানার নিতে পারেনি।’

আরও পড়ুন : জিএম কাদেরের ‘নীরবতা’র অনুবাদ— নির্বাচনকালীন সরকার হবেই!

‘দলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গুরুত্ব থাকা উচিত। মানুষ ভুল করতেই পারে। সংশোধনের সুযোগ দেওয়া উচিত। আইনও সংশোধন করা যায়। মানুষ সংশোধনের সুযোগ থাকবে না কেন? দল ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। দল হবে সামষ্টিক। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। কারও প্রতি আমার ক্ষোভ থাকবে না। আমি বিএনপির শুভকামনা করি। ভালো থাকুক তারা।’

গতকাল অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে ‘রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ : তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে আসছেন শমসের-তৈমুর’ শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

সেখানে বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। রাজনীতিতে চলছে শেষ মুহূর্তের নানা সমীকরণ। এমন একটি সমীকরণের কথা জানা গেল আজ। সাবেক বিএনপি নেতা প্রয়াত নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠিত ‘তৃণমূল বিএনপি’ নিয়ে আসছে নতুন চমক। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম কাউন্সিল হবে। সেদিন দলটিতে যোগ দেবেন রাজনৈতিক অঙ্গনে আগে থেকে পরিচিত ও আলোচিত মুখ শমসের মবিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একটি রাজনৈতিক মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নামের সঙ্গে মিল থাকা তৃণমূল বিএনপিতে নতুন চমক থাকছে। দলটির শীর্ষ দুই পদে (চেয়ারম্যান ও মহাসচিব) আসতে যাচ্ছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য (বহিষ্কৃত) এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমুর আলম খন্দকার। শুধু তারা নয়, পর্যায়ক্রমে বিএনপি থেকে বিভিন্ন সময় বাদ পড়া এবং নিজ থেকে ছেড়ে দেওয়া নেতারাও এ দলে যোগ দেবেন। সেই তালিকায় বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারও আছেন।

এ প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি তো আর আওয়ামী লীগে যোগ দেব না। সারা বছর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি করে আসছি। আর বিএনপি আমাকে গত দেড় বছর ধরে বহিষ্কার করে রেখেছে। আমি তো আর দল ছাড়িনি।’

অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার (ফাইল ছবি)

‘একজন বহিষ্কৃত লোক কত বছর একটা পতাকা টেনে নিতে পারে? এখন আমার পরিচয় কী? মারা গেলে আমার পরিচয় কী হবে? কোন ব্যানারে আমি বক্তব্য দেব। আমার জন্ম তো রাজপথে। যেহেতু বিএনপি আমাকে বহিষ্কার করেছে, সেহেতু আমাকে এখন তৃণমূল বিএনপিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। আমি সেখানেই যাচ্ছি’, যোগ করেন তিনি।

তৃণমূল বিএনপির শীর্ষ দুই পদের একটিতে আপনি থাকছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এ নেতা বলেন, আশা করি শীর্ষ পদেই থাকব। আর আমাদের রাজনীতি হবে ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয়তাবাদী ধারা ও খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে।

বিএনপির আরেক নেতা শমসের মবিন চৌধুরী কি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, তিনিও আমাদের সঙ্গে থাকছেন। কথা হয়েছে, ১৯ তারিখ তৃণমূল বিএনপির সম্মেলন আছে। দলে যোগ দেওয়ার জন্য বিএনপির আরও অনেক নেতা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

আরও পড়ুন : গুজব নিয়ে আতঙ্কে বিএনপি

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে শমসের মবিন চৌধুরীর কাছে ফোন দেওয়া হলেও তিনি একটা মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে তাকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি আর সাড়া দেননি।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে পররাষ্ট্র-সচিব ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি অবসরে যান। ২০০৮ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং ২০০৯ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন। ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।

পরবর্তীতে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন ও প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। এখনও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিকল্পধারা থেকে পদত্যাগ করেননি।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব জাহাংগীর আলমের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। দলটির নিবন্ধন নম্বর ৪৫। নির্বাচনী প্রতীক ‘সোনালী আঁশ’। নাজমুল হুদার মৃত্যুর পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন তার মেয়ে অন্তরা হুদা।

তৃণমূল বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিতব্য দলটির প্রথম সম্মেলন উপলক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ব্যাপক শো-ডাউন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সম্মেলন শেষে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মাঠে থাকার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূল বিএনপির একজন নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে নতুন মুখ আনা হচ্ছে। যারা একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও তৃণমূল বিএনপি অংশ নেবে। তখন বিএনপিতে যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী থাকবেন তারা এ দলে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

এ বিষয়ে তৃণমূল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অন্তরা হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শমসের মুবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার আমাদের দলে যোগ দিচ্ছেন। তারা একটা ভালো পদে থাকবেন আশা করি। আমরা এমন একটা সময় দলের নিবন্ধন পেয়েছি, সেখানে কারও ইন্টারেস্ট ছিল কী না সেটা আমি জানি না।

এক প্রশ্নের জবাবে অন্তরা হুদা বলেন, বিএনপিকে ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। আবার তাদের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করি সেটাও কিন্তু না। বিএনপি হয়ত নির্বাচনে আসবে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে সব দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে অংশ নিলেই আমরা সরকারের দালাল হয়ে গেছি, এটাও তো ঠিক না। তবে, আমরা কোনো জোটে যাব কী না, সেটি এখনও ঠিক করিনি।

এমএইচডি/এমজে