ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া

রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ড. ইউনূসের বিপক্ষে ‘বিবৃতি দিতে অস্বীকৃতি’ ও ‘ড. ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন’ বলে মন্তব্য করে আলোচনায় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। তিনি এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছেন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরানের মন্তব্য নিয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বক্তব্য দিয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। আর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো পক্ষকে খুশি করার জন্য তিনি এমনটা করেছেন

সরকারের পক্ষের লোকজন এখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরানের সমালোচনায় মুখর। অন্যদিকে সরকারবিরোধীরা এমরানকে বাহবা দিচ্ছেন। তারা বলছেন, সরকারের আইন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরও বাস্তবতা উপলব্ধি করে সঠিক বক্তব্য দিয়েছেন ডিএজি এমরান।

এদিকে, ড. ইউনূস ইস্যুতে বিস্ফোরক মন্তব্যের পর সবার মনে প্রশ্ন, কে এই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান? তার আসল পরিচয়ই বা কি? তিনি কেন এমন বক্তব্য দিলেন?

কে এই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমরানের পৈত্রিক বাড়ি কুমিল্লায়। বাবা সুলতান আহম্মদ ভূঁইয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।   

এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার মায়ের নাম সুরাইয়া সুলতানা। তিনি মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পর দুবারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সুলতান আহম্মদ ভূঁইয়ার চাকরির সুবাদে তার পরিবার পরবর্তীতে চট্টগ্রামে স্থায়ী হন। 

সুলতান আহম্মদ ভূঁইয়া ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ড. ইউনূসও ওই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আর এমরান ১৯৯২-৯৩ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি আইন বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক দুই শিক্ষার্থী (বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী) ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এমরান ছাত্রলীগ করতেন। আইন পড়া শেষ করে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্টে প্র্যাকটিসের অনুমতি পান এবং ২০০৫ সালের ২১ জুলাই সদস্য পদ লাভ করেন। এরপর ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি একজন মন্ত্রীর সুপারিশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

হঠাৎ কেন ইউনূসের পক্ষে অবস্থান?

অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে দেখা যায়, তার ফেসবুকের কভারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি রয়েছে। ফেসবুক ব্যবহার শুরুর পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ-সরকারের উন্নয়নের কথাই তুলে ধরেছেন। কিন্তু হঠাৎ নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। তার অবস্থান পরিবর্তনে হতবাক অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সহকর্মীরা।

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের তার তিন জন সহকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমরান বিচারপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তদবির করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। কিন্তু পরপর দুই নিয়োগে তিনি বিচারপতি হতে পারেননি। এতে তার মনে ক্ষোভ জন্মেছে। আবার কেউ বলছেন, এমরানের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে আমেরিকায় থাকেন। আমেরিকান ভিসা নিশ্চিত করতেই তিনি ড. ইউনূসের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

এমরান কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে করেন আরেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান মনির। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি কিছু লোভের বশবর্তী হয়ে কাজটা করেছেন। ড. ইউনূস ও তার লোকজন দীর্ঘদিন ধরে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার অফিস থেকে ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি নেওয়ার ষড়যন্ত্র করে আসছিলেন। এ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ও লোভে পা দিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তার এসব কর্মকাণ্ড।

আসাদুজ্জামান মনির বলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান উচ্চভিলাষী। তিনি বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াতেন বিচারপতি নিয়োগের তালিকায় তার নাম প্রথমদিকে রয়েছে। কিন্তু গত নিয়োগেও যখন তিনি বিচারপতি হতে পারলেন না, তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কারো সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল না।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরানের অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে ফেসবুক পোস্ট করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে। ফেসবুক পোস্টের একাংশে তিনি লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি মনে করে শেখ হাসিনার পক্ষে থেকে বা বাংলাদেশের সঙ্গে থেকে কি সুবিধা বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে বা পাওয়া যাবে তার চেয়ে অধিক সুবিধা যদি ড. ইউনূসের পক্ষে বা আমেরিকার সঙ্গে থেকে পাওয়া যায় তাহলে একজন ব্যক্তি কেন শেখ হাসিনার পক্ষে থাকবেন? কোনো ব্যক্তি যদি দেখেন শেখ হাসিনার পক্ষে থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়া গেছে। এরপর বিচারপতি হওয়ার রিপিটেড চেষ্টা করেও আর এগোতে পারেননি। তারপরে হতাশ হয়ে দেশের ওপর ভীতশ্রদ্ধ হয়ে সপরিবারে আমেরিকা চলে যাওয়ার চেষ্টা করে দুইবার ভিসা রিফিউজ হলে সেই ব্যক্তির আর কীইবা করার থাকে! শতভাগ ভিসা কনফার্ম করার মিশন নিয়ে ড. ইউনূস বা আমেরিকার পক্ষ নেওয়া ছাড়া!’

‘অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের কাগজে সাইন না করা এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে হতে পারত, গোপন থাকতে পারত, যখন সাংবাদিক ডেকে সংবাদ সম্মেলন করে কোনো কাগজে সাইন না করার বিষয় প্রচার করা হয় তখন বুঝতে হবে এখানে অনেক বড় কোনো লাভের বিষয় আছে। এখানে শুধু ভিসা কেন? ড. ইউনূস তো আবার বড় লোক, টাকা গুনেন এক কোটি-দুই কোটিতে নয়, গুনেন হাজার কোটিতে। তাই *** (অশালীন শব্দ) বিষয় আছে, *** পেটে পড়লে আর যাই হোক মাথা ঠিক থাকে না। না হলে বিচার বিভাগের সঙ্গে কাজ করে বিচার বিভাগ তথা বিচারিক প্রক্রিয়াকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে?’

সব বিষয়ে বক্তব্য নিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়াকে বারবার কল করলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।

কী করেছেন এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করা এবং বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত মাসে খোলা চিঠি দিয়েছেন ১৭৫ জন বিশ্বনেতা

এরপর এ চিঠির বিপক্ষে বেশ কিছু বিবৃতি দেওয়া হয়েছে দেশের ভেতর থেকে। এরকমই একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করবেন না বলে সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমকে জানান সরকারের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। একইসঙ্গে তিনি বলেন যে, ড. ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া বলেন, ড. ইউনূসের পক্ষে ১৭৫ জন বিদেশি ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটনও রয়েছেন। ওই বিবৃতির বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাকে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি ইউনূসের বিপক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব না

অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে— এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া এমন কথা বললেও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ড. ইউনূসের বিপক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

ড. ইউনূসের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে লেখা খোলা চিঠির বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি সরকার। গত ২৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন— ‘ভদ্রলোকের যদি এতই আত্মবিশ্বাস থাকে যে তিনি অপরাধ করেননি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। যারা বিবৃতি দিয়ে তার বিচার স্থগিত করতে বলেছেন তাদের বলছি, বিবৃতি না দিয়ে আইনজীবী পাঠান। এক্সপার্টরা দেখুক, অনেক কিছু পাবেন। আমাদের দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। সবকিছুই আইন মতো চলে। কেউ যদি ট্যাক্স (কর) না দেয় আর যদি শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করে, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে যদি মামলা করা হয়... আমাদের কি সেখানে হাত আছে যে মামলা বন্ধ করে দেব?’

পরে ওই চিঠির বিষয়ে বিবৃতিতে ১৪ দল বলে— চলমান বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে বেআইনি ও অযৌক্তিক দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট দেশি-বিদেশি কিছু ব্যক্তির খোলা চিঠি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হুমকি। 

এ বিষয়ে নিন্দা আসে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ থেকেও। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের ১৭১ জন বিশিষ্ট নাগরিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী এক বিবৃতিতে বলেন— ওই খোলা চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর স্পষ্ট হুমকি হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের বিবেকবান নাগরিক  হিসেবে আমরা বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর এ ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।

বিদেশিদের লেখা ওই খোলা চিঠির প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দেশের ৫০টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ ও ১৩টি জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশন।

এমএইচডি/এসএসএইচ/