বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০০ জন ড্রাইভারসহ বেশ কয়েকটি শূন্য পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ২১ অক্টোবর। তার একদিন আগেই ২০ অক্টোবর পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশ ওই দিন (২০ অক্টোবর) বিকেলে উত্তর সম্বলিত ৮০টি প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শুরুর এক ঘণ্টা আগেই নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। 

এ ঘটনায় গত বছরের ২৬ অক্টোবর গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপ-পরিদর্শক মো. শরীফুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। গত ২২ জুন এ মামালার চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে ডিবি পুলিশ। চার্জশিটে বাংলাদেশ বিমানের ডিজিএম মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ারসহ ২৬ কর্মকর্তা/কর্মচারী ও চার চাকরি প্রত্যাশী মিলিয়ে মোট ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ৪২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

বুধবার (৫ জুলাই) আদালতের বিমানবন্দর থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মো. ফরিদ মিয়া ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, গত ২২ জুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন।

এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিমানের ডিজিএম মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ার ও তার দুই ড্রাইভার জাহাঙ্গীর ও মাসুদ সিন্ডিকেট চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

বিমানের প্রধান কার্যালয় থেকেই ফাঁস হয় প্রশ্ন

চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, এ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর মেজর তাইজসহ কমিটির ৪ সদস্য বিমানের জিএমের কক্ষে অল্প সময়ের জন্য মিটিং করে ১৯ অক্টোবর প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ১৯ অক্টোবর সকাল ১০টায় মেজর তাইজসহ কমিটির ৪ সদস্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান কার্যালয়ের ৩য় তলায় অবস্থিত জিএম (অ্যাডমিন) এর অফিসে প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। সেদিন বিমানে ট্রেনিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল এবিএম নাজমুল হুদা জুনিয়র অপারেটর পদের জন্য ২০টি করে ৪০টি প্রশ্ন পেনড্রাইভে করে অফিসে নিয়ে আসেন। বিমানের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কায়সার জামান অন্যান্য পদের জন্য প্রশ্নপত্রও পেনড্রাইভে নিয়ে আসেন। তারা প্রশ্নপত্র সেট করার পর মেজর তাইজকে চেকব্যাক করতে বললে তিনি একটি প্রিন্ট কপি চান। এ সময় অন্যান্য সদস্যদের অগোচরে মেজর তাইজ খসড়া প্রশ্নপত্রের ছবি তোলে আসামি মাসুদ ও জাহাঙ্গীর আলমকে সরবরাহ করেন। মাসুদ ও জাহাঙ্গীর আলম ২ জনেই মেজর তাইজের ড্রাইভার ছিলেন।

টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র দেওয়ার কথা জানান মেজর তাইজ

পরীক্ষার ৩-৪ দিন আগে আসামি জাহাঙ্গীর মেজর তাইজকে জানান তার ৩-৪ জন প্রার্থী রয়েছে। তখন তাইজ জাহাঙ্গীরকে জানান তিনি প্রশ্নপত্র ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন বিনিময়ে তাকে কি দেওয়া হবে? একইভাবে আরেক ড্রাইভার মাসুদ জানান তার ২ জন প্রার্থী রয়েছে। ২ জনের চাকরি হলে তিনি ৪ লাখ টাকা নিতে পারবেন। মেজর তাইজ তখন জানান ৪ লক্ষ টাকা থেকে ২ লক্ষ তিনি নেবেন এবং বাকি ২ লাখ মাসুদকে দেবেন। 

শতাধিক চাকরি প্রত্যাশীর সঙ্গে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন

শুধু এ পরীক্ষা নয় এর আগেও বিমানের নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেন তাইজ-জাহাঙ্গীর-মাসুদ সিন্ডিকেট। জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর মধ্যে একটি ডায়েরিতে ২০২২ সালের ৩ জুন তারিখ উল্লেখ করে মেজর তাইজকে ২৪ লাখ টাকা দেওয়ার তথ্য উল্লেখ রয়েছে। 

৩০ আসামির ২৬ জনই বিমানের

চার্জশিটে উল্লেখিত ৩০ আসামির মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা/ কর্মচারী। এর মধ্যে ১১ জন বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা হলেন, বিমানের এমটি অপারেটর মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. মাসুদ, মো. মাহবুব আলী, এনামুল হক, মাহফুজুল আলম, বিমানের এমএলএসএস মো. জাহিদ হাসান, হারুন অর রশিদ, সমাজু ওরফে সোবহান, মো. জাকির হোসেন, অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেন ও ওয়ার্কশপ হেলপার মো. জাবেদ হোসেন। এদের মধ্যে ১০ জন আসামি আদালতে দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। 

পলাতক দেখানো আসামিরা হলেন, বিমানের ডিজিএম মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ার, এমটি অপারেটর মহসিন আলী, মিজানুর রহমান, ফারুক হোসেন, নজরুল ইসলাম, ফিরোজ আলম, সুলতান হোসেন, ট্রাফিক হেল্পার আল আমিন, আ. মালেক, আব্দুল্লাহ শেখ, সাজ্জাদুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, সিডিউলিং সুপারভাইজার মো. মাহবুব আলম শরীফ, সিকিউরিটি গার্ড মো. আইউব উদ্দিন, তাপস কুমার মণ্ডল ও চার চাকরি প্রত্যাশী মো. মুরাদ শেখ, ফারুক হোসেন, জুয়েল মিয়া এবং মো. রাজিব মোল্লা। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার অবেদন করা হয়েছে। 

ওয়ারেন্ট জারি হলে পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে ব্যবস্থা

লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার(ডিসি) মো. মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রশ্নফাঁসে বিমানের জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে চেয়েছিলেন। যে যার মতো একাধিক পরীক্ষার্থীর সঙ্গে লেনদেন করেছেন। একেকজনের সঙ্গে কমপক্ষে সোয়া লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত লেনদেনের পাঁয়তারার তথ্য মিলেছে। 

প্রধান অভিযুক্ত আসামিসহ পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার চেষ্টা সম্পর্কে তিনি বলেন, মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। আদালত চার্জশিটের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানির পর যদি পলাতকদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি করেন তবেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। মামলার চার্জশিট দাখিলের পর আদালতের নির্দেশনা ছাড়া আসামি গ্রেপ্তারের সুযোগ নেই। 

তবে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধান অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বাহিনীই দেখবে এটাই স্বাভাবিক। সেনাবাহিনী বিষয়টি অবগত। প্রধান অভিযুক্ত আসামি দেশে নাকি বিদেশে সেটা সেনাবাহিনীই ভালো বলতে পারবে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী ঢাকা পোস্টকে জানান, মামলার তদন্ত চলাকালীন প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সেনা সদর দপ্তরে আসামি তাইজ ইবনে আনোয়ারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছি। তারা আসামির বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা সেটা জানি না। যতদূর জানি তিনি সম্ভবত খাগড়াছড়িতে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে সংশ্লিষ্টরা তাদের গ্রেপ্তারে তৎপর হবেন। এটা আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হবে।

এনআর/এসকেডি