উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে, প্রমোট করা হয়েছে। রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে চলতে দিন। পুলিশের অন্যায় ও বেআইনি কাজকে প্রশ্রয় দেবেন না।

মঙ্গলবার (১৩ জুন) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

শুনানির শুরুতে আবেদনকারী আইনজীবী মজিবুর রহমান আদালতে জামিন পাওয়া ব্যক্তিদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া আসামিদের থানায় নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে। আসামিরা জামিন সংক্রান্ত অ্যাডভোকেট সার্টিফিকেট দেখালে সেটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। আসামিদের এক ভাইয়ের প্রস্রাব আরেক ভাইকে খাওয়ানো হয়েছে। এরপর টাকার জন্য আসামি বকুলের স্ত্রী সানজিদাসহ দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারারাত আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করে তাদের ৭২ লাখ টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। নারী-শিশুরা পর্যন্ত এ নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি।

আইনজীবী বলেন, এটা কী তাহলে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে? তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমরা এর প্রতিকার চাই।

আদালত বলেন, আসামির জামিন পাওয়া হোক, আর না পাওয়া হোক। এ ধরনের নির্যাতনের অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে?

এসময় আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পীকে ডায়াসের সামনে ডেকে জানতে চান জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওসিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

তখন হাইকোর্ট বলেন, সেটা তো পুলিশের তদন্ত কমিটি আর ওসিকে তাহলে তো আরও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রমোট করা হয়েছে। এটা তো কোনো প্রকার শাস্তি নয়।

আদালত বলেন, ডিএজি সাহেব আদালতের আদেশ ও আইন অমান্যকারীদের বিচারে কোর্টকে সহযোগিতা করুন। রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চলতে দিন। পুলিশের অন্যায় ও বেআইনি কাজকে প্রশ্রয় দেবেন না।

তখন ডিএজি বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালত যথাযথ আদেশ দিক, সেটা আমরাও চাই।

শুনানি শেষে হাইকোর্ট উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে তলব করেন।

একইসঙ্গে উচ্চ আদালতের জামিন পাওয়া আসামিদের কারাগারে পাঠানোয় শরীয়তপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করা হয়েছে। আগামী ১৬ জুলাই তাদের সশরীরে হাজির হতে বলা হয়েছে।

এছাড়া উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা আদায়ের ঘটনায় পুলিশ মহাপরিদর্শক ও শরীয়তপুরের পুলিশ সুপারকে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে।

এর আগে সকালে এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে আবেদন করেন আইনজীবী মজিবুর রহমান। গত ১১ জুন বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন তিনি। তখন আদালত বলেন, লিখিত আবেদন দাখিল করুন। আমরা এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়া কয়েকজন আসামি ও তাদের স্বজনদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ৭২ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হয়।

এদিকে ভুক্তভোগীর বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু জেলা পুলিশ সুপার বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন। এ ঘটনায় শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মোহাম্মদ বদিউজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। ঘটনায় অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার।

বর্বর নির্যাতনের অভিযোগ

পুলিশ, ভুক্তভোগী ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদার কান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হন। জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে তারা এ মামলার আরেক আসামি আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান। ওইদিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির, ওসি মোস্তাফিজুর রহমান ও জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০/১২ জন পুলিশ সদস্য।

এসময় সাদ্দাম তাদের জামিনের কাগজ দেখালে তা ছিঁড়ে ফেলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। পরে পুলিশ সাদ্দাম ও বকুলকে লাথি, কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়সহ লাঠি (ডাণ্ডা), কাঠ, হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। একপর্যায়ে প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। সাদ্দাম পানি পান করতে চাইলে ছোট ভাই বকুলকে দাঁড় করিয়ে মুখে প্রস্রাব করতে বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির। পরে সাদ্দামের শরীরে প্রস্রাব করেন বকুল। এমন নির্যাতন চলে রাত ১টা থেকে পরদিন ৩১ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত।

কিছুক্ষণ পর ওই চারজনকে গামছা ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর নিচে আনা হয়। পরে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল ও আনোয়ারকে পৃথক দুই স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি সাদ্দাম-বকুলকে বলেন, ‘সাইদুল-আনোয়ারকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিয়েছি। তোরা ৭২ লাখ টাকা দিবি, তা না হলে তোদেরও ক্রসফায়ার দিয়ে দেওয়া হবে’। এভাবে তাদের সারাদিন রেখে রাতে পদ্মা সেতুর দক্ষিণ থানায় এনে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে বেত, কাঠ, কোদালের বাট ও লাঠি দিয়ে আবারও বেধড়ক মারা হয় সাদ্দাম ও বকুলকে। সারারাত চলে এ নির্যাতন। এরপর টাকার জন্য বকুলের স্ত্রী সানজিদা, দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ চোকদার, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারারাত আটকে রাখা হয় এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরে আত্মীয়-স্বজনরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসির কাছে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকা দিলে নির্যাতন থেকে মুক্তি মেলে সাদ্দাম ও বকুলের। এ দুইদিন তারা যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও তাদের খাবার ও ওষুধ দেননি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি।

এমএইচডি/এফকে