সেই ওসির বিরুদ্ধে রোগীর স্বজনকে মারধরের প্রমাণ পায়নি সিআইডি
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগে নগরের পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (তথ্যগত ভুল) জমা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিবেদনে মামলার দুই আসামি পাঁচলাইশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজিম উদ্দিন এবং একই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল আজিজকে ঘটনার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে।
সোমবার (১৫ মে) দুপুরে বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং সিআইডি চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ইউনিটের পুলিশ সুপার (এসপি) শাহনেওয়াজ খালেদ।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হয়েছে। মামলার বাদী ও তার মাকে মারধরের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সবমিলিয়ে মামলাটি তথ্যগত ভুল মর্মে গত ১১ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মামলার অভিযোগে বলা হয়- মোস্তাকিমের মাকে লাথি মারা হয়েছে। অথচ তার মা তখন চমেক হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারে ছিলেন।
আরও পড়ুন <-> রোগীর স্বজন পিটিয়ে ‘পলাতক’ পাঁচলাইশ থানার ওসি-এসআই
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে কি না আমরা জানি না। নিয়ম হচ্ছে প্রতিবেদন দেওয়ার আগে বাদীকে অবহিত করতে হয়। এক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। ভুক্তভোগীকে নির্যাতনের বিষয়টি পরিষ্কার। বিভিন্ন মিডিয়ায় বিষয়টি এসেছে। এ সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সেখানে শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। মামলাটির তদন্তের সময় ভুক্তভোগীর ছেড়া পাঞ্জাবি জব্দ করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এটি পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা। তদন্তও করেছে পুলিশ। এজন্য আমরা মনে করি যথাযথ তদন্ত হয়নি। প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আমরা আদালতে নারাজি দেব।
আদালত সূত্র জানায়, পুলিশ হেফাজতে মারধরের অভিযোগে ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালতে একটি পিটিশন মামলা দায়ের করেন চমেক হাসপাতালের আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার সৈয়দ মোহাম্মদ মুনতাকিম ওরফে মোস্তাকিম। একই পিটিশনে আসামি করা হয় এসআই আবদুল আজিজকে। আদালত পিটিশনটিকে নিয়মিত মামলা হিসেবে পাঁচলাইশ থানায় রেকর্ডের আদেশ দেন। একইসঙ্গে মামলাটি এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা দিয়ে সিআইডিকে তদন্তের আদেশ দেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মোস্তাকিম তার মাকে ৭ বছর ধরে ডায়ালাইসিস করান। সম্প্রতি ডায়ালাইসিস মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তিনিসহ রোগীর স্বজনরা মিলে আন্দোলন করেন। ঘটনার দিন ১০ জানুয়ারি তারা চমেক হাসপাতালের প্রধান গেটে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সেখানে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে ওসি নাজিম মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিচে মারধর করেন এরপর তাকে থানায় নিয়ে পুনরায় মারধর করেন। মারধরের সময় এসআই আবদুল আজিজ মোস্তাকিমকে বলেন ‘ওসি নাজিম স্যারের সাথে আর বেয়াদবি করবি?’। এসময় ওসি নাজিম বলে ‘শালারে রিমান্ডে এনে থানায় পেটাতে হবে, তারপর বুঝবি পুলিশ কি জিনিস?’। এরপর থানায় মারধরের বিষয়টি ফাঁস করলে মোস্তাকিমকে ক্রসফায়ার দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন <-> ৭৮ দিন ধরে ‘অসুস্থ’ রোগীর স্বজন পেটানো সেই ওসি-এসআই!
এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় নিয়মিত মামলা হয়। নিজের থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি হন ওসি নাজিম উদ্দিন এবং এসআই আবদুল আজিজ। তবে মামলা দায়েরের আগের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটিতে যান দুজনই। এরপর থেকে তারা দুজনেই আর কর্মস্থলে আসেননি।
আইনজীবীরা বলেছেন, থানায় মামলা দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত আসামিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অথবা আসামি স্বেচ্ছায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আবার আসামি যদি সরকারি কর্মকর্তা হন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার রীতি রয়েছে। তবে ওসি নাজিম এবং এসআই আজিজকে গ্রেপ্তার করেনি মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তারা কেউ আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি এবং কাউকে বরখাস্তও করা হয়নি। মামলার আদেশের পর থেকে দুজন ছুটির অজুহাতে আর থানায় আসেননি।
উল্লেখ্য, ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০২৩ সালের শুরুতে চমেক হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনরা আন্দোলনে নামেন। কয়েকদিন ধরে চলা এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১০ জানুয়ারি বিক্ষোভকারীরা চমেকের প্রধান ফটকের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। এ দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা দেন। বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি নিজের মুঠোফোন বের করে বিক্ষোভকারীদের ভিডিও ধারণ করেন এবং তাদের পরে দেখে নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। এরপর একযোগে সবাই ওসির বিরুদ্ধে হইচই শুরু করেন এবং ভিডিও ডিলিট করার দাবি জানান।
চমেক হাসপাতালে কিডনি রোগীদের স্বজনদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। এদিন ওসির মারমুখী আচরণের ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। মানবিক এ আন্দোলন থেকে একজনকে মারতে মারতে গ্রেপ্তার করেন ওসি নাজিম। গ্রেপ্তার মোস্তাকিমও ওসির সেই মোবাইল সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে হাতাহাতিতে ওসির মোবাইল মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। এরপর ওসি মোস্তাকিমকে পেটাতে পেটাতে চমেকের প্রধান ফটকের বিপরীতে এপিক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও তাকে আরেক দফা মারধর করা হয়। কিছুক্ষণ পর এপিকের সামনে থেকে আরও একজনকে ওসি ধরে ভেতরে নিয়ে যান। পাশাপাশি অন্য পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে দেন।
একপর্যায়ে একজনকে ছেড়ে দিলেও মোস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর ওই দিন রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় মোস্তাকিমকে। এছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও কর্তব্য কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মোস্তাকিমকে ১১ জানুয়ারি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এরপর ১৫ জানুয়ারি তাকে জামিন দেন আদালত। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন মোস্তাকিম।
এমআর/এমজে