র্যাবের হেফাজতে নারীর মৃত্যু : রাষ্ট্র কেন মামলা করল না?
নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট প্রশ্ন রেখে বলেছেন, চার দিন পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি কেন? পরিবারের সদস্যরা মামলা করেনি তো কি হয়েছে? রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই? অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র মামলা করতে পারে। অভিযোগ উঠেছে র্যাবের হেফাজতে এই নারীর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
সোমবার (২৭ মার্চ) বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ করে এ কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। আদালতে এ খবর উপস্থাপন করে তিনি বলেন, ‘গত বুধবার (১৯ মার্চ) তাকে (সুলতানা জেসমিনকে) আটক করে হেফাজতে নেয় র্যাব। আটক করার ৩১ ঘণ্টা পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর হেফাজতে নেওয়ার পর অসুস্থ হলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গত শুক্রবার (২৪ মার্চ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার মাথায় আঘাত পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমি খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছি এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তবে নিহতের পরিবারের অভিযোগ ওই নারীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ সত্য হলে এটি খুবই গুরুতর অভিযোগ। বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন >> র্যাবের হেফাজতে নারীর মৃত্যু : পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাইকোর্টে তলব
এ সময় হাইকোর্ট সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদকে উদ্দেশ করে বলেন, এই মুহূর্তে খোঁজ নেন কোনো মামলা হয়েছে কি না। ১৫ মিনিটের মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানান।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনারের কাছে খোঁজ নেওয়ার পর সহকারী আইন কর্মকর্তা দাউদ আদালতে বলেন, গত ২৪ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তের পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, আদালত জানতে চাইলে আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, নিহতের পরিবারের সদস্যরা এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি। এ কারণে রাষ্ট্রও মামলা করেনি।
এ সময় আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘কে বলেছে রাষ্ট্র মামলা করতে পারে না? কোথায় পেয়েছেন? পরিবারের সদস্যরা মামলা করেনি তো কি হয়েছে? রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্ব নেই? রাষ্ট্র কেন মামলা করল না। অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র মামলা করতে পারে। অভিযোগ উঠেছে হেফাজতে এই নারীর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’
মাথায় আঘাতের বিষয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কি বলা হয়েছে, আদালত তা জানতে চাইলে আবুল কালাম খান দাউদ বলেন, ‘এ বিষয়গুলো জানতে হলে সময় দিতে হবে। ময়না তদন্তের রিপোর্টটি আনতে হবে।’
তখন হাইকোর্ট বলেন, ‘এখনি ফ্যাক্স করে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে বলেন। পত্রপত্রিকায় এসেছে ওই নারীর মাথায় আঘাতের কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু পত্রিকার প্রতিবেদন ধরে তো আর বিচার করা যাবে না। আমাদের দেখতে হবে আগে থেকেই মাথায় ইনজুরি ছিল কি না, নাকি নতুন ইনজুরি হয়েছে এবং সে ইনজুরির কারণে তার মৃত্যু হয়েছে কি না। কেন তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। কারা হেফাজতে নিয়েছিল, কে বা কারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, নাম-পদবীসহ বিস্তারিত উল্লেখ করে আমাদের জানান।’
রাষ্ট্রপক্ষকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘দেশের মানুষ আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকে দেখতে যে, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেন কি না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে মিলেই তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধুমাত্র বিচার না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা ন্যায়বিচার করতে চাই।’
এরপর আদালত আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিককে নিহতের পরিবারের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিয়ে আদেশের বিষয়ে আবেদন নিয়ে আসতে বলেন। পরে আদালত নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তলব করেন। মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) সকালে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে সুলতানা জেসমিনকে হেফাজতে নেওয়ার কারণ, র্যাবের কে বা কারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তাদের নাম-পদবী উল্লেখ করে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদনও দিতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষকে। প্রতিবেদনে ওই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে আইন ও সর্বোচ্চ আদালতের আদালতের রায়ের নির্দেশনা মানা হয়েছে কিনা, তাও উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নওগাঁয় র্যাবের হেফাজতে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) জয়পুরহাট ক্যাম্পের সদস্যরা সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামে ওই নারীকে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বজনেরা।
গত শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়। এর আগে গত বুধবার (২২ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের নওযোয়ান মাঠের সামনে থেকে ওই নারীকে আটক করে র্যাব।
সুলতানা জেসমিন সদর উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন। শহরের জনকল্যাণ মহল্লায় ভাড়া থাকতেন তিনি।
স্থানীয় ও মৃতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার সকালে প্রতিদিনের মতো অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে রওনা হন সুলতানা জেসমিন। পথে সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের নওযোয়ান মাঠের সামনে পৌঁছালে সাদা রঙের মাইক্রোবাসযোগে এসে তাকে আটক করে নিয়ে যায় র্যাব-৫ জয়পুরহাট ক্যাম্পের সদস্যরা। আটকের প্রায় ২ ঘণ্টা পর দুপুরে সুলতানাকে অসুস্থ অবস্থায় নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে র্যাব। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন থাকার পর তার অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। রামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে তার মৃত্যু হয়।
সুলতানা জেসমিনের মামা নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু বলেন, বুধবার আমার ভাগ্নি অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলে রাস্তা থেকে র্যাব তাকে আটক করে নিয়ে যায়। তবে তাকে কোথায় নেওয়া হয়েছিল তা তাৎক্ষণিক জানা যায়নি। দুপুরে ভাগ্নির মোবাইল ফোন থেকে আমাদের নাতি সৈকতকে কল করে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে আসতে বলে র্যাব। বিষয়টি জানার পর দুপুর ২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখি ভাগ্নিকে স্যালাইন দেওয়া অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। পাশেই র্যাবের সদস্যরা ছিল। সুলতানা কথা বলতে পারছিল না। পরে তার অবস্থা গুরুতর হলে সন্ধ্যায় তাকে রামেকে নেওয়া হয়। রামেকে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সকালে সুলতানার মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, সুলতানা শুক্রবার মারা গেলেও ওইদিন রামেকে তার পোস্টমর্টেম হয়নি। এজন্য পরের দিন র্যাব তার পোস্টমর্টেম করে আমাদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে। আমার ভাগ্নির মরদেহ দাফন হওয়া পর্যন্ত র্যাব প্রকাশ্যে এবং গোপনে আমাদের চারিদিকে অবস্থান করেছে। সুলতানাকে সকালে তুলে নেয় আর দুপুরেই হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাই ভেতরে একটা সন্দেহ থেকেই যায়। এ সময়ের মধ্যে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়ে থাকতে পারে।
এমএইচডি/জেডএস