ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর নির্যাতনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজ্ঞাত সদস্যদের বিরুদ্ধে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের করা মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

রোববার (১৪ মার্চ) বিকেলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত এ আদেশ দেন।

আদালত নির্যাতনের ফলে কিশোরের কান, পা ও শরীরের অন্য স্থানগুলোতে আঘাত পেয়েছেন, সেগুলো পরীক্ষা করতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালককে নির্দেশ দেন। ওই কমিটিতে একজন করে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, অর্থোপেডিক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ রাখতে বলা হয়েছে। এই কমিটি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করাবে। কিশোর যেসব নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন, সেগুলো কত সময়ের ব্যবধানে হয়েছে সম্ভব হলে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে নির্দেশ দেন আদালত।

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর নির্যাতনের ঘটনায় বুধবার (১০ মার্চ) কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজ্ঞাত সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন। এরপর আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণ করে নথি পর্যালোচনা শেষে আদেশ পরে দেবেন বলে জানান।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ৫ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর গ্রেফতার হন। কিন্তু এর তিনদিন আগে ২ মে বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে তার বাসা থেকে সাদা পোশাকধারী ১৬/১৭ জন তাকে মুখোশ পরিয়ে হাতকড়া লাগিয়ে নির্জন অচেনা জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর ২ মে থেকে ৩ মে পর্যন্ত তাকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়।

নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগে কিশোর বলেন, গত বছরের ২ মে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বাসার কলিংবেলের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। দরজা খুললেই অপরিচিত একজন আমাকে বলে, দরজা খোলেন না কেন? পরনের লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে আসেন। সঙ্গে একটি ভালো শার্ট পরেন। আমি তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা আমাকে পরিচয় দেয়নি। তাদের আলাপ-আলোচনায় একজনকে জসিম বলে ডাকতে শুনি। সবাই ঘরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করেন। তারা আমাকে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখাতে পারেননি। বাসা থেকে আমার মোবাইল, সিপিইউ ও যত ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস ছিল তা অবৈধভাবে নিয়ে যায়।

আমাকে যখন হাতকড়া পরিয়ে বাসার নিচে নামানো হয়, তখন বাসার সামনে ৬/৭টি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। আমার বাসার সামনে অনেক লোকজন জড়ো হয় এবং একটি গাড়িতে আমাকে ওঠানো হয়। আমি তখন জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু গাড়িতে তারা অনেক জোরে শব্দ করে গান বাজাচ্ছিল। হয়তো এজন্য আমার চিৎকার বাইরে শোনা যাচ্ছিল না।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, পরে বুঝতে পারলাম আমাকে পুরনো একটি স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। এরপর প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটির পর একটি কার্টুন দেখানো হচ্ছিল। সেগুলোর মর্মার্থ জানতে চাওয়া হয়। করোনা নিয়ে আমার কিছু কার্টুন দেখিয়ে সেগুলো আঁকার কারণ জানতে চাওয়া হয়। একপর্যায়ে আমার কানে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হয়। এরপর আমি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলি। বুঝতে পারছিলাম আমার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তারপর স্টিলের পাতের লাঠি দিয়ে আমার হাঁটুতে আঘাত করা হয়। যন্ত্রণা ও ব্যথায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি আমি। এভাবে ২ মে থেকে ৪ মে পর্যন্ত আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

কিশোর আরও উল্লেখ করেন, পরে আমি নিজেকে র‍্যাব কার্যালয়ে দেখতে পাই। সেখানে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুশতাক বলেছিলেন, তাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল। এরপর গত বছরের ৬ মে আমাদের রমনা থানায় হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কান দিয়ে পুঁজ পড়ে, হাঁটতে পারি না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা কার্টুনিস্ট কিশোর ১ মার্চ হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ৩ মার্চ তাকে ছয় মাসের জামিন দেন হাইকোর্ট। গ্রেফতারের ১০ মাস পর ৪ মার্চ দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ থেকে মুক্তি পান ‍তিনি।

টিএইচ/এসএসএইচ