সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একমাত্র নারী বিচারপতি তার বিদায়ী বক্তব্যে বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে কলমে নিরঙ্কুশভাবে বাস্তবায়ন হলেও একজন বিচারক যদি তার মননে, চলনে, বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত।

বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে তার শেষ কর্মদিবসে দেওয়া বিদায়ী সংর্বধনায় তিনি এ মন্তব্য করেন।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে তাকে বিদায়ী সংর্বধনা দেওয়া হয়। এ সময় প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের চারজন বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বক্তব্যের শুরুতে বলেন, প্রতিক্ষিত, সুনির্দ্দিষ্ট, এই বিদায়ক্ষণে প্রথমেই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি। যার অসীম কৃপায় আজ আমি আমার ৪১ বছরের বিচারিক জীবনের শেষ দিনের শেষ কথাগুলো বলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।

আজকের এ দিনে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ত্রিশ লাখ শহীদ ও নির্যাতিতা মা-বোনদের। যাদের আত্মত্যাগের কারণে এই সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। আর একটি সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছিলাম বলেই আমি আজ এই অবস্থানে।

ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, আজ সকাল থেকেই একটি ছবি বারবার স্মৃতিতে ভেসে আসছিল। আমার বাবা তখন পটিয়াতে মুনসেফ। আমি ৩/৪ বছরের শিশু। আমাদের কোয়ার্টারের সামনে বড় একটি পুকুর ছিল তার ওপাড়েই পটিয়া চৌকি কোর্ট। রোজ সকালে দেখতাম একজন ভদ্রলোক ওই পুকুরে স্নান শেষ করে আদালত ভবনে দাঁড়িয়ে সেখানে প্রণাম করতেন। বাবাকে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম তিনি একজন আইনজীবী, স্নান শেষে তিনি আদালতকে প্রণাম করে তার দিন শুরু করতেন। আমি বিশ্বাস করি, শত অবক্ষয় আমাদের কুঁড়েকুঁড়ে শেষ করে দিলেও আজও এমন অনেক আইনজীবী আছেন যারা এই বিচারাঙ্গনকে অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন এবং আমি এই আশা নিয়েই আজ এই অঙ্গন ছেড়ে যাচ্ছি যে, সেসব আইনজীবীদের দেখানো পথেই আমরা এই অবক্ষয় থেকেও একদিন মুক্তি পাব।

তিনি বলেন, আমি ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল যখন হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে শপথ নেই তখন এই অঙ্গনে নিজেকে বড্ড অচেনা লাগতো। আর আজ এ ক্ষণে আমার সামনে/পাশে যারা উপবিষ্ট আছেন সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে আমরা একই সুতায় গাঁথা একটি মালা ছিলাম। নিতান্ত সময়ের অঘোম নিয়মে আজ আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।

আজকের এই দিনে আমি আমার বাবা, মাকে স্মরণ করি। বিশেষ করে স্মরণ করি আমার স্বর্গীয় বাবা শ্রী দীনেশ চন্দ্র দেবনাথকে। যিনি আমার সুদীর্ঘ চাকরিজীবনে যখনি কোনো অশনি সংকেত এসেছে, আর আমি চাকরি করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখনি তিনি বলেছেন চাকরি না ছাড়তে, বলেছেন তিনি আমার চাকরিজীবনের একটি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। আমি স্মরণ করি আমার মা, স্বর্গীয় বেনু দেবনাথকে, যিনি সদাসর্বদা বলেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু ধৈর্য ধরতে হয়। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার স্বামী স্বপন দত্তকে। যার কাছে আমার দুটি শিশু কন্যাকে রেখে আমি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বদলিজনিত কারণে কর্মরত থেকেছি। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার পরিবারের সব সদস্যদের যারা প্রতিনিয়ত আমার পাশে থেকেছে যেকোনো বিপদের সময়। যেকোনো সফলতার সময়। কৃতজ্ঞতা জানাই আমার এই ৪১ বছরের সব সহকর্মীকে, সব আইনজীবীদের যাদের কাছে প্রতিনিয়ত আমি কিছু না কিছু শিখে এসেছি। যাদের সহযোগিতা ছাড়া এ সুদীর্ঘ পথ একা পাড়ি দেওয়া কখনই সম্ভব ছিল না।

আপিল বিভাগের তৃতীয় এ নারী বিচারপতি বলেন, সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, সেটি হলো, আমার এই ৪১ বছরের বিচারিক জীবনে এ বিশ্বাসে আমি উপনীত হয়েছি যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে কলমে নিরঙ্কুশভাবে বাস্তবায়ন হলেও একজন বিচারক যদি তার মননে, চলনে, বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করে তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত।

আজকের এই শেষ দিনে এ আশা নিয়েই বিচারাঙ্গন থেকে বিদায় নিতে চাই যে, একজন বিচারক বিচারকাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন, এই মূলমন্ত্র ধারণ করেই বিচারকাজ সম্পন্ন করবেন। আর আপনারা অর্থাৎ আইনজীবীরা সে কাজে সহযোগিতা করবেন এই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই।

আমি আমার বক্তব্য বেশি দীর্ঘায়িত করব না। শুধু বলব আমার ৪১ বছরের বিচারিক জীবনে আমি বহুবার বিদায় নিয়েছি। কিন্তু কর্মজীবন থেকে আজ আমার শেষ বিদায়। এরপর শুরু হবে আমার নতুন জীবন। আপনারা সবাই প্রার্থনা করবেন আমার জীবনের শেষ অধ্যায়টি যেন আমি আমার পরিবার পরিজন নিয়ে সহজ সরল, আনন্দময় আর সুস্থভাবে কাটিয়ে অনির্ধারিত শেষ বিদায়কে আলিঙ্গন করতে পারি।

গত ৯ জানুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কৃষ্ণা দেবনাথ। নারী হিসেবে তিনি আপিল বিভাগের তৃতীয় বিচারপতি। 

এর আগে আপিল বিভাগে দুইজন নারী বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি জিনাত আরা। তারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে গেছেন। আজ ছিল বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের শেষ কর্মদিবস। তিনি ৯ অক্টোবর অবসরে যাবেন। কিন্তু ওই সময় অবকাশকালীন ছুটি থাকায় আজই তিনি বিচারপতি হিসেবে শেষ কর্মদিবস পালন করলেন।

১৯৫৫ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালের ১ নভেম্বর পদোন্নতি পান জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে। ১২ বছর জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পান। দুই বছর দক্ষতার সঙ্গে অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড ল’ স্কুলে সার্টিফিকেট কোর্সে অংশ নেন বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। ১৯৯৬ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগ দেন। ২০১২ সালে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে।

এমএইচডি/জেডএস