দীপন হত্যা মামলায় ৮ আসামির মৃত্যুদণ্ড
জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় ৮ আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান এ আদেশ দেন।
দুপুর ১২টা ২ মিনিটে ৫৩ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু হয়। রায় শুনতে আদালতে দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমানসহ আরও দুই স্বজন আদালতে হাজির হন। এর আগে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে আদালতের হাজতখানা থেকে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আসামিদের হাজির করা হয়।
বিজ্ঞাপন
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মেজর (বরখাস্তকৃত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে স্বাদ, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার এবং শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের। এদের মধ্যে প্রথম দু’জন পলাতক রয়েছেন।
রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংসের উদ্দেশ্য ছিল আসামিদের
রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করে দেওয়াই দীপন হত্যা মামলার আসামিদের উদ্দেশ্য ছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।
পর্যবেক্ষণ বিচারক বলেছেন, ‘ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার কারণে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এ সদস্যদের লক্ষ্য ছিল ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদের হত্যা করে মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া। মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। আর এসবের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দেওয়া’।
বিচারক আরও বলেন, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা বাংলাদেশের জননিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে দেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমূলক কার্য করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।’
সন্তুষ্ট নয় আসামিপক্ষ, উচ্চ আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
দীপন হত্যা মামলায় আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলেও জানিয়েছেন।
রায় ঘোষণা শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম এ বি এম খায়রুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আসামিদের মধ্যে ছয় জন উপস্থিত ছিলেন। বাকি দুই জন পলাতক। তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু এ মামলায় একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও নেই। মূলত ঘটনাস্থলে কেউই ছিল না। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। উচ্চ আদালতে গিয়ে আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা রায়ে সন্তুষ্ট নই। আদালত রায় দিতেই পারেন। তবে যেহেতু উচ্চ আদালতে যাওয়ার অধিকার আছে, আসামিরা উচ্চ আদালতে যাবে। সমাজে এসব হত্যাকাণ্ড ও অসঙ্গতির বিচার হোক এটা আমরাও চাই। তবে আমরা ন্যায়বিচার চাই। এখানে আসামিরা দাবি করছেন তারা ন্যায়বিচার পাননি।
দীর্ঘদিন আটক রেখে নিজেদের (পুলিশ) শেখানো ১৬৪ ধারায় আসামিদের কাছ থেকে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করেন।
কাঁদলেন দীপনের স্ত্রী
দীপন হত্যা মামলার রায় শুনে কেঁদেছেন তার স্ত্রী রাজিয়া রহমান। মূলত পেছনের ঘটনা স্মরণ করেই তিনি কেঁদেছেন, হয়েছেন বাকরুদ্ধও। রায়ে সন্তুষ্ট কিনা জানাতে চাইলে গণমাধ্যমের কাছে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রায়ে সন্তুষ্ট রাষ্ট্রপক্ষ
দীপন হত্যা মামলায় আট আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আদালতের এমন রায়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান ৫৩ পৃষ্ঠার রায় পড়ে শোনান। পরে আদালত চত্বরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।
তিনি বলেন, দীপন হত্যা মামলার মোট আসামি আটজন। তাদের মধ্যে দুজন পলাতক আছেন। বাকি ছয়জনকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। আদালত সকল আসামিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। এছাড়া প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে গোলাম ছারোয়ার খান জাকির আরও বলেন, ‘আদালত বলেছেন, আসামিরা আনসার-আল ইসলামের সদস্য। তারা সাভারের ব্লগার রিয়াদ মোর্শেদ বাবুকে হত্যা করে। আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক টুটুলের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায় এসব সন্ত্রাসী। জিহাদের অংশ হিসেবে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার-আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের তথা অত্র মামলার আসামিদের লক্ষ্য ছিল প্রকাশক, ব্লগার, লেখকদের হত্যা করে মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া। মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। এসবের উদ্দেশ্য হলো- মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করা, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে ধ্বংস করে দেওয়া।’
‘ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে পরিকল্পনা করে হত্যা করে আসামিরা। এজন্য আদালত সকল আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। মামলার রায়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট।’
তিনি আরও বলেন, যে দুজন আসামি এখনও পলাতক, আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট যাবে। এছাড়া আদালত থেকে সাজাপরোয়ানা ইস্যু করলে অর্থাৎ যেদিন থেকে গ্রেপ্তার হবে সাজা সেদিন থেকে কার্যকর হবে। মামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক।
রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু মামলায় সহায়তাকারী হিসেবে ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।
রায় ঘোষণা পর আসামিদের প্রতিক্রিয়া
যখন বিচারক মজিবুর রহমান রায় পড়া শুরু করেন তখন থেকেই আসামিরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ও হাসাহাসি বন্ধ করে দেন। রায় পড়া মনোযোগ দিয়ে তা শুনতে থাকেন। তবে রায় পড়া যত এগোতে থাকে, আসামিদের মুখে কালো ছাপ ততই বাড়তে থাকে। বিচারক যখন ওই হত্যাকাণ্ডের দায়ে আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন তখন এজলাসের থাকা ৬ আসামি নিস্তব্ধ হয়ে যান। তাদের মুখের হাসি ও উচ্ছ্বাস হারিয়ে যায়। তারা নিশ্চুপে আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়েন।
দীপন হত্যা মামলার রায় কেন্দ্র করে এদিন সকাল থেকেই আদালত ও এর আশেপাশের এলাকায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা।চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, আদালত এলাকায় পথচারীদের চলাচলে পুলিশের কড়া নজরদারি। আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশেও চলছে পুলিশি তল্লাশি। শিথিল করা হয়েছে সর্ব সাধারণের চলাচল।
নিরাপত্তার দায়িত্বে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীপন হত্যার রায়কে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাতে থেকেই আদালত প্রাঙ্গণ ও এর আশেপাশের এলাকায় তারা অবস্থান নিয়েছেন।
রায় ঘোষণার আগে এজলাসে আসামিরা যা করছিলেন
বেলা ১১টা ২ মিনিটে আসামিদের এজলাসে উঠানো হয়। এ সময় তাদের নিশ্চিন্ত দেখা যায়। এমনকি হাসিমুখে একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিলেন তারা। শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তাদের চেহারায় ভয়ভীতি বা আতঙ্ক দেখা যায়নি।
এ সময় একজন আসামিকে দেখা যায় আদালতে কক্ষে কতজন মানুষ উপস্থিত হয়েছেন তা গুনে অন্য আসামিদের বলছেন। বিচারক আসার আগ পর্যন্ত আসামিরা নিজদের সঙ্গে ও পুলিশের সঙ্গে এভাবেই হাস্যোজ্জ্বলভাবে বিভিন্ন কথা বলেন।
গত ২৪ জানুয়ারি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য এ তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত। মামলায় ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সেদিন বিকেলে তার স্ত্রী শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি দক্ষিণের সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমান। চার্জশিটে ৮ জনকে অভিযুক্ত ও ১১ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
টিএইচ/জেডএস/এমএআর